Dr. Neem on Daraz
Victory Day

মৌলভীবাজারের শিল্পীদের মানবেতর জীবন


আগামী নিউজ | জেলা প্রতিনিধি প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০২০, ০১:০৯ পিএম মৌলভীবাজারের শিল্পীদের মানবেতর জীবন

মৌলভীবাজারঃ দেশের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি মৌলভীবাজার জেলা। দেশের কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম। পর্যটন শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ জেলায় রয়েছে বৈচিত্র্যময় পরিবেশ, দৃষ্টিনন্দন চা বাগান ও মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ।

চা বাগানের নান্দনিক সৌন্দর্য মৌলভীবাজারকে প্রকৃতি কন্যার পরিচিতি এনে দিয়েছে। জেলার বিস্তৃত অঞ্চলে ছোট ছোট টিলা, পাহাড় ও সমতলে ৯২টি চা বাগান রয়েছে। নদনদী পরিবেষ্টিত ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এ জেলার অন্যান্য আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, হামহাম জলপ্রপাত, দেশের দ্বিতীয় ও বৃহত্তর ইকোপার্ক মাধবকুণ্ড, মাছ ও পাখির অভয়াশ্রম বাইক্কা বিল, হাকালুকি হাওর, বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক, মাধবপুর চা বাগান ও লেক, হজরত শাহ মোস্তফার মাজার শরিফ, বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ সিপাহি হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ, পৃথিমপাশা নবাব বাড়ি, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মনু ব্যারেজ, শ্রীমঙ্গল টি-রিসোর্ট, হাইল হাওর, মণিপুরী পল্লী, খাসিয়া পল্লী, প্রাকৃতিক গ্যাস ট্রান্সমিশন প্ল্যান্ট, কাগাবালা পাখি বাড়ি, ঐতিহাসিক খোজার মসজিদ, কমলার বাগান, রাজনগরে পাখি বাড়ি। মণিপুরী, খাসিয়া, সাঁওতাল, টিপরাসহ নানা আদিবাসীর সহাবস্থান। নানা ধর্ম বর্ণের শিল্প-সংস্কৃতি যেখানে মিলেমিশে একাকার সেখানেও হানা দিয়েছে করোনা।

সূত্র জানায়, মৌলভীবাজারে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংখ্যা সত্তরের কাছাকাছি। সংস্কৃতি কর্মীর সংখ্যা রয়েছে প্রায় ১ হাজার। এদের মধ্যে পেশাগতভাবে সংস্কৃতি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্তদের ২০০ জনের তালিকা দেয়া হলেও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মাত্র ১০০ জনকে প্রণোদনা সহায়তা দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মৌলভীবাজারের অধিকাংশ শিল্পী অসহায়ভাবে জীবনযাপন করছেন। নিরুপায় হয়ে মুদি দোকানের চাকরি, শ্রমিকের কাজসহ কেউ কেউ কৃষি কাজও করছেন। অনেকে আত্মসম্মানের ভয়ে কারো কাছে হাত পেতে চাইতেও পারছে না। করোনাকালে এসব শিল্পীদের জন্য বরাদ্দকৃত অনুদান সমভাবে বণ্টনও হয়নি। হয়েছে ব্যাপক বৈষম্য আর স্বজনপ্রীতি। প্রকৃত তালিকা করে প্রকৃত শিল্পীদের হাতে সরকারের প্রণোদনা সহায়তা দেয়ার দাবি জানিয়েছেন সংস্কৃতিকর্মীরা।

জানতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক ঐক্য জোটের সভাপতি আব্দুল মতিন বলেন, সংস্কৃতিকর্মীরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। বেকারত্বের বোঝা টানতে গিয়ে শিল্পীরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। যারা সরকারের প্রণোদনা পাওয়ার কথা ছিল তারা পায়নি। তাদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে, হয়েছে স্বজনপ্রীতিও। এটা অনেক কষ্টের।

প্রকৃত শিল্পীদের নতুন তালিকা করে তাদের হাতেই প্রণোদনা সহায়তা দেয়ার দাবি জানিয়ে ৪৪ বছর ধরে সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আরো বলেন, যাদের সঙ্গে শিল্পকলার লোকদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো তারাই সহায়তা পেয়েছেন। এরকম চলতে থাকলে সংস্কৃতির ১২টা বাজবে।

৩০ বছর ধরে সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত সম্মিলিত সাংস্কৃতিক সংসদের সদস্য সচিব আনোয়ার হোসেন দুলাল বলেন, আমাদের রক্তের মধ্যে সংস্কৃতি মিশে গেছে। এজন্য সংস্কৃতি ছাড়তে পারছি না। কিন্তু শিল্পীদের এ অহঙ্কার ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে করোনা। এখানকার বাউলদের অবস্থা খুবই খারাপ। তিনি বলেন, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে জমি বিক্রি করে দিয়েছি। তারপরও চেতনা বুকে নিয়ে আছি! এক্ষেত্রে সরকার যে সহায়তা দিয়েছে তা একেবারেই অপ্রতুল। এর পরিমাণ বাড়িয়ে তা অব্যাহত রাখা উচিত।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ নানা আন্দোলনে সম্পৃক্ত সংগীতশিল্পী দীপক বসাক বলেন, দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে সংগীত চর্চার সঙ্গে রয়েছি। জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো ভাবিনি। আমি জেলা যুবলীগের সংস্কৃতি সম্পাদকও ছিলাম। কিন্তু আমি তো শিল্পী, রাজনৈতিক সুবিধা নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শিল্পকলায় প্রণোদনার জন্য আবেদনও করেছিলাম। কিন্তু পেলাম না।

দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে দোতারা বাজিয়ে সংসার চালান রবি বাদ্যকর। এই শিল্পী বললেন, আমার পেশাই হচ্ছে দোতারা বাজানো। দোতারা বাজিয়েই আমার সংসার চলে। এখন নিরুপায় হয়ে মানুষের বাড়িতে কাজ করছি। গরুর ঘাস কাটছি। শিল্পকলার ৫ হাজার আর জেলা প্রশাসনের ২ হাজার টাকা পেয়েছি। সরকারের দয়ার অপেক্ষায় আছি।

নৃত্যশিল্পী রুবেল দাস বলেন, নৃত্যই আমার একমাত্র পেশা। আমার ওপর নির্ভরশীল আমার পুরো পরিবার। ৮ মাস ধরে আমার আয়ের পথ বন্ধ থাকায় অনেক কষ্টে আছে আমার পরিবার। এখন নিরুপায় হয়ে সেলাইয়ের কাজ করছি। চোখে কিছু দেখছি না। সংগীতশিল্পী ও শিক্ষক অনুরাধা রায় অর্পা জানান, শিল্পকলা কিংবা জেলা প্রসাশন কারো সহায়তাই পাননি তিনি। এমনকী শিল্পকলায়ও তিনি আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কোথাও কোনো সাড়া পাননি। ফলে কষ্টে এপাশ ওপাশ করে কাটছে এই শিল্পীর জীবন।

আগামীনিউজ/এএইচ