Dr. Neem on Daraz
Victory Day

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সংকট


আগামী নিউজ | নাজমুল হাসান ফাহিম প্রকাশিত: অক্টোবর ১৬, ২০২০, ০৬:৫২ পিএম আপডেট: অক্টোবর ১৭, ২০২০, ০৮:৫২ এএম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সংকট

যখন এই লেখাটি লিখছি তখন দেশে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল, তাতে কী ?

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের হালচাল তো আগের মতোই বেহাল। কেউ বাপ-মার শেষ জমানো টাকা এনে টিউশন ফী দিচ্ছে , কেউবা টিউশন ফী দিতে না পেরে পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়েছে। এদের বিশাল সংখ্যাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী।

আজকের আয়োজন- এদের সংকট মানে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট নিয়ে।

সোজা কথায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ছাত্র ছাত্রীদের প্রধান দুইটা সমস্যা হলো-

১. টিউশন ফী। ২. যথাসময়ে পর্যাপ্তভাবে কোর্স সম্পন্ন করা নিয়ে।

 

টিউশন ফী প্রসঙ্গ

 

প্রথমে রাঙ্কিয়ের শীর্ষে থাকা ৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি কমন প্রোগ্রামের প্রতি ক্রেডিট ঘন্টার টিউশন ফী দেখে নেয়া যাক –

বলাবাহুল্য, ইকোনমিক্স, বিবিএ , এলএলবি এগুলো ল্যাববিহীন কোর্স. বাদবাকি সিএসই, ই ই ই, আর্কিটেচার এগুলোতে ল্যাব আছে বলে খরচ একটু বেশি হবার কথা। কিন্তু, উপরের চার্ট থেকে দেখা যায়- নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় যেন রীতিমতো টাকার খেলা জুড়ে দিয়েছে। এরা ইকোনমিক্স, বিবিএ, এল এল বি এরকম বিষয়ে যেগুলোতে ল্যাব নেই সেগুলোতেও গলাকাটা টিউশন ফী চড়িয়ে দিয়েছে শিক্ষার্থীদের উপর। এ ক্ষেত্রে, ইস্ট ওয়েস্ট ভার্সিটি অনেকটা নমনীয় তারা ল্যাববিহীন কোর্স বিশেষ করে ইকোনমিক্স ,এলএলবি তে কম টিউশন ফী দিয়েছে। এ তো গেলো টিউশন ফী র হিসেব। কিন্তু, এ ছাড়াও সেমিস্টার ফী নামে “ নুনের ছিটা ”দেওয়া হয়েছে স্টুডেন্টদের "কাটা গায়ে"।

মূলত, আইটি সুবিধা, স্টুডেন্ট এক্টিভিটিজ, লাইব্রেরি ফী নিয়ে তৈরি হয় এই সেমিস্টার ফী নামক সর্ষে ফুল। দেখা যায়, দুই / তিন সেমিস্টার পর এই সেমিস্টার ফী বাড়ানো হয় ৬০০০– ৬৫০০– ৭০০০ অনেকটা এইভাবে। বলা দরকার সব বিষয়ে আইটি  এক্টিভিটিজ এক রকম নয় যেমন ম্যাথমেটিক্স, এলএলবি, ইকোনমিক্স ইত্যাদি বিষয়গুলোতে থিওরি পড়াশুনা বেশি। তাই, লাইব্রেরি দরকার বেশি। কিন্তু, অন্য এক্টিভিটিজের দরকার কম। কিন্তু, তারপরও স্টুডেন্ট এক্টিভিটিজ নাম দিয়ে সবার কাছ থেকে নির্বিচারে একই টাকা আদায় করে এই কসাইরা। এ যেনো মামা বাড়ির আবদার।

এত ক্ষণ তো শীর্ষ কয়েকটা প্রাইভেট ভার্সিটির টিউশন ফী র মাধ্যমে শিক্ষা ব্যাবসার আলাপ দিলাম। অবস্থা এমন যেনো – ডিম পাড়ে হাসে, খায় বাঘডাসে। শিক্ষার্থীদের টাকা নামক ডিম ক্ষমতাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অথোরিটি বাঘডাসের মতো কপাত কপাত করে গিলছে আর বাঘডাসের পাহারাদার “বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন” যেন ঘুমন্ত চৌকিদার। আশেপাশে যাই হোক , ঘুম ভাঙবে না তার।

এবার তাহলে কোর্স / প্রোগ্রাম ইত্যাদির মাধ্যমে যে বাণিজ্যটা হয়, তার দিকে একটু চোখ ঘুরাই –

ভার্সিটির মূল কাজ হলো বিষয়ভিত্তিক কোর্সগুলোতে নজর দেয়া। কিন্তু, একই দেশের কিছু শীর্ষ প্রাইভেট ভার্সিটি বিষয় ভিত্তিক কোর্সে জোর কমিয়ে ইংলিশ ভাষা কোর্স, নন ডিপার্টমেন্টাল কোর্স করানোর পবিত্র দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে।

উদাহরণ স্বরূপ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে ইংলিশের তিনটা কোর্স- ENG 091(নন ক্রেডিট), ENG101, ENG102 দুইটি ক্রেডিট কোর্স। উপরের কোর্সগুলি যদি ৪ মাসে হয় তবে ৩টা কোর্স করতে ৪×৩ = ১২ মাস স্টুডেন্টদের প্রায় এক বছর খেয়ে দেয়া হয়। যেখানে পাবলিক ভার্সিটি বড় জোর ছয় মাসের সেমিস্টারে একটি ইংলিশ কোর্স থাকে। ১ কোর্সে ১৮০০০ হলে ৩টি ইংলিশ কোর্স ৫৪০০০টাকা, ১ কোর্স ১৯৫০০ হলে ৩টি ইংলিশ কোর্স ৫৮৫০০টাক্‌ ১ কোর্স ১৯৮০০ হলে ৩টি ইংলিশ কোর্স ৫৯৪০০টাকা।

তাছাড়া, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটা লাভজনক পণ্য আছে যার নামে "প্রি ইউনিভার্সিটি"। কেউ যদি ENG091 করার যোগ্য বলে বিবেচিত না হয় তবে তাকে এই Pre–University করতে হয়। আবার কেউ কেউ দেখা যায় ৪ মাসব্যাপী Pre–University কোর্স করে টিকতে না পেরে পরে অন্য জায়গায় গিয়ে ভর্তি হয়। এবার একটু টাকা হিসেব করি – এই কোর্স কমপক্ষে ৩ মেয়াদে ১৬০০০ × ৩ = ৪৮০০০টাকা খরচ হয়। তার চেয়ে লজ্জার ব্যাপার হলো কোর্সের শিক্ষা সামগ্রী (পেন্সিল/পোস্টার/মার্কার / কাচি/ গাম) ইত্যাদি। তাদের রিকমেন্ডেড দোকান (জে এন্ড জে কর্নার ) থেকে কিনার জন্যে সুন্দর করে বলে দেয়া হয়।

তাছাড়া এগুলোতে জোর দিলেও ৪ মাস সেমিস্টার হওয়াতে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক কোর কোর্স যেমন –

১। Microeconomics I ,II

২। Macroeconomics I , II

৩। Calculus I , II

৪। Real Analysis I , II

৫। Differential Equation I , II

৬। Statistical Mechanics/ Fluid Mechanics

৭। Data Structures / Algorithms ( CSE )

৮। Social Theory / Economy and Society (Anthropology )

৯। Microbial Chemistry / Microbial Metabolism (Microbiology)

১০। virology /Medical Microbiology (Microbiology )

১১। Human Physiology / Enzyme and Enzymes Kinetics (Biotechnology )

১২। Bioorganic Chemistry /Microbial Biotechnology (Biotechnology )

১৩। Principle Of Linguistics /English Poetry

১৪। English Drama/English Prose

- এটি পরিষ্কারভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা যায়- উপরে প্রত্যেক জোড়া কোর্স পাবলিক ভার্সিটিতে (যদিও পাবলিক ভার্সিটিতে শিক্ষার বেহাল দশা) শেষ হয় ৬×২ =১২ মাসে। কিন্তু, প্রাইভেটে শেষ হয় ৪×২ =৮ মাসে। অর্থাৎ, ৪ মাস কম সময়ে সংক্ষিপ্তভাবে সিলেবাস শেষ করা হয়। কেউ শিখতে চাইলেও সুযোগ নেই। যে জন্যে ভার্সিটির কিছু শিক্ষক আপ্রাণ চেষ্টা করে পড়ালেও সময় স্বল্পতার জন্যে কয়েক জন ছাড়া বাকিদের বুঝানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাহলে, অর্থনীতি (১,২) গণিত (৩,৪,৫), পদার্থবিদ্যা (৩,৬), সি এস ই (৩,৭), নৃবিজ্ঞান (৮), মাইক্রোবায়োলজি (৯,১০), বায়োটেকনলজি (১১,১২) , ইংরেজি সাহিত্য (১৩,১৪) ইত্যাদি বিষয়ে উল্লেখিত প্রধান কোর্স জোড়া। যেগুলো স্ব স্ব বিষয়ে পরিষ্কার জ্ঞান লাভের একটা সুবিন্যস্ত ভিত্তি গড়ে তুলবে। সে সকল বিষয় বিস্তারিত পড়ানোর নাম নেই।

অথচ, ভাষা শিক্ষা কোর্স / নন ডিপার্টমেন্টাল কোর্স ইত্যাদি কমিয়ে যদি উল্লেখিত কোর্স গুলো একটু বিস্তারিত ভাবে সময় নিয়ে পড়ানো হতো তাহলে স্ব স্ব বিষয়ে স্টুডেন্টদের আরো আগ্রহ তৈরি হতো।

আসলে এইভাবে প্রথমত সেমিস্টার ফী, টিউশন ফী চাপিয়ে দিয়ে এবং দ্বিতীয়ত কোর্স বিস্তারিতভাবে না করিয়ে এদেশে প্রাইভেট ভার্সিটিগুলো আপাত সুন্দর কিন্তু চরম সংকটের জায়াগায় পরিণত হয়েছে।

এ যেন “ মাকাল ফল ” মানে দেখতে সুন্দর কিন্তু উপকারে আসে না কিংবা “ধুতুরা ফুল ” দেখতে সুন্দর কিন্তু খেতে বিষাক্ত।

 

লেখকঃ নাজমুল হাসান ফাহিম

স্নাতক

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়