Dr. Neem on Daraz
Victory Day

ওজন স্তরের ক্ষতির কথা যেন ভুলে না যাই


আগামী নিউজ | রিপন আশরাফ প্রকাশিত: জুন ২৯, ২০২০, ০৯:১২ পিএম ওজন স্তরের ক্ষতির কথা যেন ভুলে না যাই

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিবেদন অনুযায়ী তাপমাত্রায় বিপজ্জনক বৃদ্ধি এড়াতে বিশ্বকে "দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে"।
জাতিসংঘের বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের গ্রহটি ১২ বছরের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির চূড়ান্ত সীমা ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। যেটা কিনা প্রাক-শিল্পযুগের মাত্রার থেকেও বেশি।
এতে করে আবহাওয়া পরিস্থিতি অস্বাভাবিক রূপ নেবে বিশেষ করে চরম দুর্ভিক্ষ, দাবানল, বন্যা সেই সঙ্গে লাখ লাখ মানুষের খাদ্য সংকটের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। তাপমাত্রার এই সীমা অতিক্রম এড়াতে, বিশ্বের উচিত, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্রুত, সুদূরপ্রসারী ও নজিরবিহীন পরিবর্তন আনা।

কি পেলাম কিছু গবেষণায়!  
গবেষকরা বেশ আগেই পৃথিবীর ওজনস্তর ধ্বংসকারী রাসায়নিক পদার্থের রহস্যজনক উত্থান শনাক্ত করেছেন । সিএফসি-১১ নামের এই রাসায়নিক পদার্থটি সাধারণত বাসাবাড়িতে উষ্ণতা বৃদ্ধির হাত থেকে রক্ষা করতে ব্যবহার করা হয়। এর অর্গানিক রাসায়নিক নাম ক্লোরোফ্লোরো কার্বন-১১। সিএফসি-১১ ট্রাইক্লোরোফোর্মমিথেন নামেও পরিচিত। যদিও ২০১০ সালের পর বৈশ্বিকভাবে এই পদার্থের উৎপাদন অনেক কমে যায়। কিন্তু উৎপাদন বন্ধ এতদিনেও হয়নি।  

বিজ্ঞানীরা গত ছয় বছর ধরে ওজনস্তরে ধীরলয়ে কিন্তু বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে এই বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন। সম্প্রতি নতুন এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হচ্ছে, চীনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ হচ্ছে এই বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাসের উৎপত্তিস্থল।  
১৯৩০ সালের দিকে ফ্রিজে ব্যবহারের উদ্দেশে প্রথম এই গ্যাসের সৃষ্টি করা হয়। যদিও প্রায় এক দশকের মাথায় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে, বায়ুম-লে সিএফসি মিশে যাওয়ার পর ক্লোরিন অ্যাটম বা কনা  ছড়িয়ে যায়, যা ওজনের স্তরকে ধ্বংস করে দেয়। অথচ ওই স্তর আমাদের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে বাঁচায়। ১৯৮০ সালের দিকে অ্যান্টার্কটিকার বায়ুমণ্ডলে প্রথম ওজনস্তরের ফাটল ধরা পড়ে।

১৯৮৭ সালে মন্ট্রিল প্রোটোকলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ক্ষতিকারক অধিকাংশ রাসায়নিক পদার্থের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে ২০৩০ সাল এবং অ্যান্টার্কটিকায় ২০৬০ সাল নাগাদ ওজনস্তরের ফাটল ঠিক হতে পারে। ২০১৮ সালে একদল গবেষক বায়ুমণ্ডলে সিএফসি গ্যাসের অত্যধিক উপস্থিতি টের পেয়ে গবেষণায় নামে। তাদের গবেষণায় বলা হয়, ২০১২ সালের পর ওজন স্তরে সিএফসির মাত্রা ৫০ শতাংশ বেড়েছে আগের তুলনায়। আর এই বিষাক্ত গ্যাসের উৎপত্তিস্থল পূর্ব এশিয়ায়। ভারত চীন জাপান এর  প্রধান উৎপাদনকারী দেশ।

চীনে গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত হয়, এমন অনেক উপকরণ তৈরিতে সিএফসি-১১ ব্যবহার করা হয়। সিএফসি-১১ বাদ দিয়ে অন্য রাসায়নিক পদার্থ দিয়েও ওই উপকরণ তৈরি সম্ভব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে চীনা কোম্পানিগুলোকে উন্নত রাসায়নিক ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিকল্প  অধিক অর্থ ব্যয় করতে হবে বলেই তারা তারা করে না। চীনের এই সমস্যা বৈশ্বিক মানবতা ও জলবায়ু বিপদাপন্নতার জন্য হুমকি হোয়া স্বত্বেও চীন সিএফসি-১১ উৎপাদন কমাতে কোনো কর্ণপাতই করছে না ।১৪০ কোটি্র  বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ  এক্ষেত্রে ভারতের অবস্থাও চীনের মতই। তারাও প্রচুর এই রাসায়নিক উৎপাদন করে থাকে। ভারতের ভুপাল মহারাষ্ট্র শহরে এই খারখানা অধিক।    

চীনের উত্তরাঞ্চলে দেশটির সবচেয়ে বেশি রাসায়নিক কারখানার অবস্থান। ওই অঞ্চলে কার্বন নির্গমনের মাত্রাও ১১০ শতাংশ। ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. ম্যাট রিগবির মতে, চীন ভারত থেকে ওই বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বাতাসে মিশছে, এটা আর গোপন কোনো বিষয় নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফা যেখানে একমাত্র আরাধ্য দেবতা, সেখানে ওজন স্তরের ক্ষতির প্রশ্নটি এই স দেশের কাছে অত গুরুত্বপূর্ণ নয়।

ভারতের বাতাসে এমন কিছু আছে, যা অন্যসব অঞ্চল থেকে ভিন্ন। ভারতীয় উপমহাদেশের বাতাসে রয়েছে ফরমালডিহাইড- একটি বর্ণহীন গ্যাস। মূলত সবুজ গাছপালাই এর উৎস। কিন্তু নানা ধরণের দূষণ থেকেও তৈরি হতে পারে ফরমালডিহাইড।

ভারত এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর বাতাসে যে ফরমালডিহাইডের পরিমাণ অনেক বেশি সেটি ধরা পড়েছে ইউরোপের একটি স্যাটেলাইটে। গত অক্টোবরে সেন্টিনেল-ফাইভ-পি স্যাটেলাইট আকাশে পাঠানো হয় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বায়ুদূষণ পরিমাপের জন্য। এটিতে ট্রপোমি বলে একটি যন্ত্র আছে যেটি বায়ুমন্ডলে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে ফরমালডিহাইডের উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাতাসে যে ফরমালডিহাইড পাওয়া যায়, তার বেশিরভাগের উৎস প্রকৃতি। কিন্তু দূষণ এবং আগুন থেকেও ফরমালডিহাইড তৈরি হয়।

ভারতের বায়ুতে যে ফরমালডিহাইড অনেক বেশি এর কারণ সেখানে ভারতের কৃষিতে এবং পল্লী অঞ্চলে আগুনের ব্যবহার অনেক বেশি। বাড়িতে রান্নার কাজে এবং ঘর গরম করতে প্রচুর কাঠ পোড়ানো হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরণের অর্গ্যানিক কমপাউন্ড যখন নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, সূর্যের আলো ইত্যাদির সঙ্গে বিক্রিয়া করছে, তখন সেটি ভুপৃষ্ঠে ওজন তৈরি করে। আর এটি মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খুবই বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে। এ থেকে তৈরি হতে পারে গুরুতর স্বাস্থ্য তবে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ফরমালডিহাইডের উপস্থিতি অনেক কম। কারণ রাজস্থানের মতো মরুভূমিতে সবুজ প্রকৃতি একেবারেই নেই, সেখানে কৃষিকাজও খুবই কম। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাদের কাছে এখন বিশ্বের বায়ু দূষণ সম্পর্কে অনেক বেশি ভালো তথ্য আছে। তবে তাদের আরও অনেক বেশি পর্যবেক্ষণ দরকার। বহু বছর ধরে এই পর্যবেক্ষণ চালাতে হবে।

বেলজিয়ামের 'রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব স্পেস এরোনোমি'র বিজ্ঞানী ইসাবেল ড: স্মেডট বলেন, এখন তারা এই বায়ু দূষণের অনেক বেশি বিস্তারিত তথ্য পাচ্ছেন। যেটা আগে সম্ভব ছিল না। কিন্তু এই তথ্য অনেক দীর্ঘ সময় ধরে সংগ্রহ করতে হবে যাতে বিস্তারিত একটা ছবি পাওয়া যায়।

বৈষ্ণিক উষ্ণতা বাড়ানোর জন্যে দায়ী এমন দ্রব্যের আমদানি এবং ব্যবহারও বন্ধ করা হবে বলে ভারত ঘোষণা দিলেও পরিবেশ প্রটোকল মানতে বছরের পর বছর অনীহা ছাড়া আর তেমন ভাল ব্যবস্থা নেওয়া হয় না ভারতের পক্ষে।
 
বাংলাদেশের চিত্র : মন্ট্রিল প্রটোকল স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ওজন স্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী ও বৈষ্ণিক উষ্ণতা বাড়াতে সক্ষম এমন দ্রব্য আমদানি নিষিদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০১৪ সালে দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার সংশোধন করা হয়। হাইড্রো ক্লোরোফ্লোরোকার্বনের আমদানি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এর আগে ২০১০ সালে ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি), মিথাইল ক্লোরোফরম, মিথাইল ব্রোমাইড আমদানি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।। পর্য‍ায়ক্রমে ওজন স্তর ক্ষয় ও বৈষ্ণিক উষ্ণতা বাড়ানোর জন্যে দায়ী এমন দ্রব্যের আমদানি এবং ব্যবহারও বন্ধ করা হবে।

আর ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে আমদানি, রপ্তানি ও বিপণন সম্পূর্ণ নিষ্দ্ধি করা হয়েছে তাপ অপরিবাহী (ইনস্যুলেশন) ফোম উৎপদনে ব্যবহার হওয়া এইচসিএফসি-১৪১বি। এরই ধারাবাহিকতায় হাইড্রো ক্লোরোফ্লোরোকার্বনের আমদানি  ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পরিবেশের ক্ষতিকারক এসব দ্রব্য যেসব ক্ষেত্রে এখনও ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলোর বিকল্প প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া  অবৈধপথে নিয়ে আসা বা নকল সিএফসি-১২ রিফ্রিজারেশন কোথাও পাওয়া গেলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ২০১৪ সালের সংশোধিত ওজন স্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার আওতায় এ নির্দেশ দিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর।  পরিবেশ অধিদফতরের এক নির্দেশনায় , পরিবশে বান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী টেকসই প্রযুক্তি নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। ওজন স্তর ক্ষয় ও বৈষ্ণিক উষ্ণতা বাড়ানোর জন্যের দায়ী এমন দ্রব্যের আমদানি ও ব্যবহারও পর্যায়ক্রমে নিষিদ্ধ করা হবে। ‘তাই রিফ্রিজারেশন এবং গৃহস্থলী, বাণিজ্যিক ও শিল্পে ব্যবহৃত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র কেনার সময় তা পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী কিনা জেনে নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।’

অতি বন্যা ক্ষরা ঘূর্ণিঝড় বজ্রপাত আগের চেয়ে বেশি এবং প্রকৃতির এই বদলা নেবার অভিঘাতে বাংলাদেশ মালদ্বীপ ভারত শ্রীলঙ্কাই সবচাইতে বড় ক্ষতির সম্মুখীন । তাই সময় এসেছে জিও থার্মাল এবং রিনিউঅ্যাবল এনার্জি ব্যবহারের দিকে নজর দেওয়া।উন্নয়নকাজ যেমন আমাদের জন্য আবশ্যিক তেমনই পরিবেশের প্রতি এই দায়িত্ব আমাদের অবশ্যই পালন করতে হবে, এক সুন্দর এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য। উন্নয়নের সাথে পরিবেশের বৈরিতার ন্যূনতম ব্যবধান হলেই তবে বিশ্বের মানব কুলের, প্রাণীকুলের জন্য শুভসংবাদ বয়ে আনবে।

আগামীনিউজ/জেএফএস