Dr. Neem on Daraz
Victory Day

বাংলাদেশে করোনায় প্রাণ প্রকৃতির উন্মেষ


আগামী নিউজ | মিথুন মুৎসুদ্দী প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২০, ০৩:০৯ পিএম
বাংলাদেশে করোনায় প্রাণ প্রকৃতির উন্মেষ

সংগৃহীত ছবি

করোনা ভাইরাসের ভয়ংকর ছোবলে যখন মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত, ত্রাহি রূপ ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক জীবনধারাসহ সবকিছু। তখন, প্রকৃতির পটে লেখা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি গল্প। পরিবেশগত পুনরুদ্ধারের আয়োজন করছে প্রকৃতি। মনুষ্য তাণ্ডবের আড়ালে আবডালেই চলছে তার হঠাৎ জাগরণের খেলা। নীরব, নির্জন, কোলাহলমুক্ত পরিবেশে মায়াময় প্রকৃতি নিজের সুষমা, সৌন্দর্যরাশি যেন একের পর এক তুলে ধরছে।
রাজধানীর রাজপথে এখন শুধু মানুষ, যানবাহন ও এর কালো ধোঁয়াই নয়, চোখে পড়ে বিস্তর সবুজও। সেই সবুজের সঙ্গে রয়েছে লাল-হলুদের সমারোহ। হালকা বাতাসে দুলছে সেসব লাল-হলুদ-সবুজ কচিপাতা আর ফুল। দেখলে বিশ্বাস হতে চাইবে না, খোদ ঢাকার রাজপথের এ রূপ। অদ্ভুত এক নীরবতায় আচ্ছন্ন এখন ঢাকা। ১১০-১২০ ডেসিবলের শব্দদূষণ নেমে এসেছে প্রায় শূন্যে। বাতাসে পিএম’র মাত্রাও অনেক নিচে নেমে এসেছে। সুইসভিত্তিক সংস্থা এয়ার ভিজুয়ালের তথ্য মোতাবেক বায়ুদূষণে শীর্ষে অবস্থানকারী ঢাকা এখন ২৩ নম্বরে। মানুষের হাতে বিপর্যস্ত প্রকৃতি যেন জীবন ফিরে পেয়েছে।কয়েক মাস আগেও ধুলোয় ধূসর মারাত্মক বায়ুদূষণে নাভিশ্বাস উঠেছিল মানুষের। করোনায় কল-কারাখানাগুলো বন্ধ থাকায় বাতাসে ধূলিকণাসহ বিষাক্ত সব পদার্থের উপস্থিতি কমেছে। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতেও ধরা পড়েছে এই পার্থক্য। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে ধরা পড়ে মার্চের ২২ তারিখ থেকে শুরু হওয়া লকডাউনের ২৫ দিনের মধ্যেই পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে রাজধানীর বাতাসে। বাতাসে কমেছে দূষিত পদার্থের পরিমাণও।
প্রকৃতির নিয়ম ধারায় ফিরে আসুক নীল আকাশ, প্রবাহিত হোক বিশুদ্ধ বাতাস। প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় সুরক্ষিত হোক ডলফিন, ডাহুক আর ঘুঘুর বসবাস। করোনা আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, প্রাণ-প্রকৃতি আমাদের আত্মার বন্ধন, একান্ত আপনজন।
অস্বাভাবিক কিছু ঘটনা চোখে পড়েছে। রাজধানীতে দলবেঁধে সশব্দে টিয়া পাখি উড়ে যাচ্ছে। ঘুঘুর অবিরাম ডাক শোনা যাচ্ছে। খুব নিচু দিয়ে মহানন্দে উড়ে যাচ্ছে চিল। অলিগলিতে বেজি ছোটাছুটি করছে। এ যেন অচেনা-অজানা এক ঢাকা।
গত ২৮ মার্চ দুপুরে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান জানায়, ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’- এর বায়ুমান সূচক (একিউআই) ইনডেক্সে ১০ নম্বরে নেমে এসেছে ঢাকা। গত ছয় মাস ধরেই দিনের বেশিরভাগ সময় প্রথম স্থান দখল করে ছিল ঢাকা। সূচক ৩৯১ পর্যন্ত উঠেছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৩০০-এর ওপরে গেলে তাকে দুর্যোগ অবস্থা বলে। কিন্তু সেই সূচক নেমে হয়েছে ১২১।বায়ুদূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম। তিনি জানান, এখনও আমরা স্বাস্থ্যকর অবস্থায় আসিনি। রাস্তায় মানুষ কমে যাওয়ার কারণে অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো। কিন্তু আমাদের দেশের বাতাস স্বাস্থ্যকর হতে হলে সূচক হতে হবে ৫০-এর নিচে। তিনি বলেন, গত ছয় মাসে বহুবার আমাদের সূচক ৪০০/৫০০ পর্যন্ত উঠেছে। সে হিসাবে আমরা এখন ভালো আছি। তিনি বলেন, এটি তো সাময়িক। আমরা তো বের হবো। এই ঘটনা দিয়ে একটি জিনিস স্পষ্ট, আমরা আমাদের নিজেদেরই ক্ষতি করে চলেছি প্রতিনিয়ত। তাই আবার যখন আমরা কাজে বের হবো, তখন যেন বিষয়টি মাথায় রাখি। আর সরকারের কাছে আবেদন থাকবে, আরও কঠোর হাতে এই দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে দীর্ঘদিন গণপরিবহন আর জনশূন্য হয়ে ছিল ঢাকা। তার ফলেই ঢাকা এখন আর দূষণের নগরী নয়। বাতাসে নেই ভারী সিসা। দীর্ঘদিন উন্নয়ন কাজ বন্ধ থাকায় বাতাসে ধুলাও কম।রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউ, ধানমন্ডি, বিজয় সরণি, মহাখালী, বনানী এবং বিমানবন্দর সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, পথের দু'পাশে লাগানো গাছগুলোতে নতুন সবুজপাতায় রোদ পড়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। পথ বিভাজনের ফুল গাছ, লতাগুল্মগুলোও সতেজ হয়ে উঠেছে।নগর কর্তৃপক্ষের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখন গাছগুলারে দেখলে মন ভরে যায়। কী সুন্দর সবুজ হয়ে উঠছে। সাধারণত এমন সময় সবুজ দেখা যায় না, ধুলার পরত পড়ে থাকে।
ঢাকার বাইরের চিত্রটাও সন্তোষজনক। গত ১৮ মার্চ থেকে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে সব পর্যটনকেন্দ্রে। নিষেধাজ্ঞার এ সারণিতে রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতও। কোলাহলপূর্ণ সৈকত যেন আজ হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। সৈকত রাজ্যের এ সুনসান নীরবতায় সবুজ গালিচা তৈরিতে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে সাগরলতা। সবুজ এ জালের মধ্যে ফুটছে অগণিত জাতের নাম জানা না-জানা বাহারি রঙের সব ফুল। কোলাহলমুক্ত সৈকত পেয়েই সাগরলতা ডালপালা মেলে দিয়ে শান্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারের পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সেন বাঞ্চু।এদিকে কক্সবাজার সমুদ্রে মানুষ নামা বন্ধের সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে দেখা যাচ্ছে ডলফিনের আনাগোনা। একইসঙ্গে নানা রকমের মাছেরও দেখা পাওয়া যাচ্ছে। দেশের এই প্রাকৃতিক পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ডা. আব্দুল মতিন বলেন,"আমরা ঘর থেকে বের হচ্ছি না বলেই এই প্রাণ-প্রকৃতির দেখা পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকায় এখন শব্দদূষণ নেই, বায়ুদূষণ নেই, নেই পরিবেশদূষণ। কক্সবাজারে ডলফিনের আনন্দ দেখতে পাচ্ছি আমরা, চীনের বহু শহরে শত শত বানর এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই ঘটনা থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট হয় যে মানুষের চাপে প্রকৃতি হারিয়ে যায়।"
তিনি বলেন, "কিন্তু এই অবস্থা তো সারাজীবন থাকবে না।  আমাদের বের হতেই হবে। কাজে যেতেই হবে। ফলে আজকের পরিস্থিতি থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া দরকার। আমাদের প্রকৃতি আমাদেরই বাঁচাতে হবে। তিনি বলেন, একটি টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার চাইলেই ঢাকার বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পরিবেশদূষণ কমিয়ে আনতে পারে। তার সঙ্গে চাই ব্যক্তিগত সচেতনতা।"পরিবেশবিজ্ঞানী ড. আনসারুল করিম বলেছেন, তিন দশক আগেও কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র তীর ধরে প্রায় ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু পাহাড়ের মতো বড় বড় বালিয়াড়ি দেখা যেত। সাগরলতার সঙ্গে সঙ্গে বালিয়াড়ি হারিয়ে যাওয়ার কারণে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের প্রায় ৫০০ মিটার ভূমি বিলীন হয়ে গেছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের সময় উপকূলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম এসব বালিয়াড়ি।
এ পসরায় সাগরপাড়ে আরও যুক্ত হয়েছে কচ্ছপের অবাধ বিচরণ। বিনা বাধায় সমুদ্রের বিশাল বালুকা বেলাভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে কচ্ছপের দল। ইতিমধ্যে ডিম পাড়াও শুরু করেছে তারা। বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় থাকা সামুদ্রিক এ কচ্ছপ সামুদ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়, বিশেষ করে খাদ্যশৃঙ্খল বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া সাগরের ময়লা-আবর্জনা খেয়ে পানি পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে তারা।
সাগরকন্যা খ্যাত পর্যটননগরী কুয়াকাটাও তার সৌন্দর্য উন্মোচনে ব্যস্ত। এঁকেবেঁকে পুরো বেলাভূমিতে লাল কাঁকড়ার আলপনা আকার দৃশ্য তারই নজির, যেন দীর্ঘদিন পর সৈকত নিজেদের দখলে পাওয়ার আনন্দ উপভোগে ব্যস্ত তারা।
সুন্দরবনেও নজরে পড়ছে বাঘ,ঘড়িয়াল, খাটাসদের যাদের আগে সরাচর দেখা মিলত না।
গবেষকরা বলছেন, করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় লকডাউনের কারণেই বাতাস ও প্রকৃতির এমন পরিবর্তন। লকডাউনের কারণে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকা, সবধরনের শিল্প কারখানা বন্ধ থাকা, এমনকি মানুষও করোনার জন্য ঘর থেকে বের হয়নি। এজন্যেই বায়ুমানে যেমন নাটকীয় পরিবর্তনের পাশাপাশি ফিরে পেয়েছে প্রাণ ফিরে পেয়েছে প্রকৃতিও। তবে শিল্প কারখানা ও যানবাহন চলাচল বৃদ্ধি পেলে ফের আগের অবস্থায় ফিরতে যেতে পারে বাংলাদেশ।
মানুষ যদি আবারও করোনাপূর্ব পৃথিবীর মতোই আচরণ করে, যদি উন্নয়ন-প্রবৃদ্ধি আর ভোগবাদিতার জন্য তারা প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংস করে পুনরায় উন্মত্ততা আর বেলেল্লাপনায় মেতে ওঠে, তার চেয়ে লজ্জার কিছু হবে না। অতএব, সরকারকে ঠিক করতে হবে, তারা করোনউত্তর পৃথিবীকে কেমন দেখতে চান। উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনতে হবে। ভোগবাদিতার অবসান ঘটিয়ে জীবন-যাপনে পরিবর্তন আনতে হবে। এই ভাইরাস যেমন মানুষ থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, এখান থেকেই শিক্ষা নিতে হবে। কীভাবে তারা আরও বেশি মানবিক ও সংবেদনশীল হতে পারে। কীভাবে প্রকৃতিকে সাবলিল রাখা যায়। ডলফিন ও হরিণের সঙ্গে মানুষ যেন যুথবদ্ধভাবে বসবাস করতে পারে, প্রকৃতির সন্তানেরা যেন মানুষের উন্মত্তরা শিকার না হয়, সেরকম একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তৈরির দিকেই সরকারকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি এটাও ভাবা দরকার পুঁজিনির্ভর ক্ষমতা মানুষকে করোনাভাইরাস মহামারী থেকে রক্ষা করতে পারেনি। মানুষের ভোগনির্ভর ক্ষমতা আর পুঁজিবাদের ক্ষমতার দিন শেষ। এখন সময় প্রাণ-প্রকৃতিনির্ভর মানবিক সমাজের। যে সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ সবুজকে ধারণ করবে আর ভোগ নয় বরং সাম্যের পথেই হাঁটবে, সে ব্যবস্থাই মানুষকে টিকিয়ে রাখবে। সার্বিক পরিবেশের উপর করোনাভাইরাসের কারণে যেসব প্রভাব পড়েছে তা পরিবেশবিদদের জন্য সবুজ সংকেত। সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য এই পরিবর্তিত পরিবেশ থেকে শিক্ষা নেয়া। তাছাড়া, যারা পরিবেশকে অশান্ত করেছে তারা পরিবেশকে শান্ত রাখতে নিজেদের বিলাসী জীবনের একটা সীমা নির্ধারণ করবে এটাই কাম্য।

আগামীনিউজ/মিথুন

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে