Dr. Neem on Daraz
Victory Day

দীর্ঘদিন পর একবার গ্রামের বাড়িতে গেলাম


আগামী নিউজ | ড. নিম হাকিম প্রকাশিত: অক্টোবর ৩, ২০১৯, ১১:৩৯ এএম
দীর্ঘদিন পর একবার গ্রামের বাড়িতে গেলাম

বিকেল বেলা গ্রামের হাটে যাচ্ছি। পথে মাদারে চাচাকে দেখলাম একটা দুধের হাঁড়ি হাতে আর মাথায় একটা ঝুড়িতে কিছু সওদা। জিজ্ঞাসা করলাম, চাচা দুধ কি দর বিক্রি করলেন? বললেন, ২০ টাকা। রোজার দিন ছিল, দুধের দাম একটু বেশি। গ্রাম বাংলার হাট থেকে কে কি সওদা করে- অনেকেই হাট থেকে ফেরার সময় তা দেখে থাকেন। আমি অনেক দিন পর মাদারে চাচার ঝুড়িটায় কি সওদা করছেন তা দেখলাম এবং এর তালিকা মোটামুটি নিম্নরুপ- এক বিড়া পান, গোটা দশেক সুপারি, তামাকের কয়েকটা বেশ চওড়া কালো পাতা, এক প্যাকেট বিড়ি, ১টা ম্যাচ, ছোট বোতলে তেল, এক পোঁটলা লবণ আর এক বোতল সিরাপ।

 

জিজ্ঞাসা করলাম, চাচা অসুখ কার? বললো বাবা, তোমার চাচির শরীর দুর্বল তাই বাজারে দুই সের দুধ, তিন হালি ডিম, এক কান্দা কলা বিক্রি করে সদাই করলাম। আর অবিনাশ ডাক্তারের দোকান থেকে শক্তির জন্য একটা সিরাপ আনলাম। মাদারে চাচা খুব ভালো সদাই করেছেন, দুধ, ডিম আর কলা যা তিনি নিজের বাড়িতে উৎপাদন করেন তা বিক্রি করে কিনে আনলেন চাচির জন্যে তামাক পাতা, নিজের জন্যে বিড়ি, আর স্বামী-স্ত্রী ও মেহমানদের জন্য পান-সুপারি, চাচির শরীর দুর্বলতার জন্য সিরাপ। ডিম, দুধ আর কলার দরকার নেই। সিরাপে চাচি সবল হবে।

 

ডাক্তারও ডিম, দুধ আর কলার কথা বলেননি। দুর্বল, তাই ভিটামিন দিয়েছেন। ডাক্তার দিবেন ওষুধ। ডিম-দুধ আর কলা তো ওষুধ নয়, এগুলো খাদ্য। ডাক্তার সাহেব সিরাপের লভ্যাংশ দিয়ে দুধ, ডিম, কলা, মাছ, মাংস এসব কিনে খান। অশিক্ষিত গ্রাম্য মাদারের চাচাকে দিয়ে এসব তার ঘরে পাঠাবেন। চাচা ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে মাথায় বয়ে দিয়ে আসবেন ডাক্তার সাহেবদের বাড়িতে।

 

এ রকম অনেক অনেক চাচা দুধ, ডিম আর কলা বিক্রি করে তামাক, পান-সুপারি কিনেন। এরকম অনেক ডাক্তার সাহেব আছেন আমাদেরই আশে পাশে, যারা সিরাপ দেন মাদারী চাচার স্ত্রীর জন্যে । ডিম, দুধ আর কলা খেতে বলেন না, কারণ এগুলো ওষুধ নয়। তিনি ডাক্তার তাই ওষুধ দেন। আমাদের এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর শতকরা ৮২ ভাগ ওই মাদারে চাচাদের দলে। অবশিষ্টাংশের মধ্যে রয়েছে এ রকম ডাক্তার সাহেবরা। গ্রামভিত্তিক এই কৃষিপ্রধান দেশে মাদারে চাচারা ছিল, আছে এবং থাকবে অনাদিকাল। আর জন্ম নেবে দিন দিন এমন অনেক ওষুধ দেওয়া ডাক্তার। কারও অজ্ঞতার সুযোগ নেয়া, কোন সহানুভুতি না থাকা, দায়িত্ববোধহীন ডাক্তার থাকবে অনাদিকাল, এভাবে আর কতকাল চলবে কে জানে। মাদারে চাচার সদাই দেখা শেষ হলো।

 

পরের দিন গেলাম চায়ের দোকানে। অনেক দিন পর গ্রামে এসেছি। এরই মধ্যে গ্রামের বাজারে পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ, সিনেমা হল, উপজেলা, কোর্ট-কাচারি, বিদেশি মিশনের সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদি মিলে সরগরম। গ্রামে তো ১০ বছর আগে এত চায়ের দোকানে ছিল না। এতো লোক কাজ-কর্ম ফেলে বিকেলে চা খেতে আসত না। রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে, জীবনযাত্রারও উন্নয়ন হওয়া স্বাভাবিক। চায়ের দোকানে অনেক লোক বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা। এরই মধ্যে মামলা-মোকদ্দমার কিছু আলাপও শুনলাম। কিছু সময় পরে দুইজন সিপাই এসে মফিজ নামে একটা ছেলেকে বাইরে ডেকে নিয়ে গেল। কয়েকজন লোক বাইরে গেল দেখতে, শুানলাম পুলিশরা মফিজকে কয়েকটা বেত লাগিয়ে দুইশত টাকা সেলামি নিয়ে গেল।

 

আমার পাশে বসা একটা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলাম, ঘটনা কী? সে বলল, মফিজ নাকি বিড়ির লেবেলের ব্যবসা করে। বিড়ির লেবেল কী জানতে চাইলে ছেলেটি বলল, বিড়ির প্যাকেটে যে কাস্টমের স্ট্যাম্প থাকে সেগুলো খুলে নিয়ে পুনরায় নতুন প্যাকেটে লাগিয়ে তা বাজারে ছাড়া হয়। এতে সরকার লক্ষ লক্ষ টাকার ট্যাক্স থেকে বঞ্চিত হয়। অনেকেই এ ব্যবসা করে। সবাই পুলিশকে পয়সা দেয়, মফিজ পুলিশকে পয়সা দেয় না বলে তাকে ধরেছে। 

 

আমি আরও জানতে চাইলাম তার নামে কি কোন মামলা আছে? অথবা তার কাছে কোন বিড়ির লেবেল পেয়েছে? ছেলেটি বলল, এসব ‘পকেট কেস’। “পকেট কেস” আমার কাছে একদম নতুন শব্দ। তাই বললাম, সে আবার কেমন? ছেলেটি বলল, ভাই আপনারা শহরে থাকেন, এসব বুঝবেন না। একটা কাগজে নাম-ঠিকানা লিখে নিয়ে এসে ধরে ফেললেই টাকা পাওয়া যায়। নামধাম লিখে পকেটে রাখে বলে আমরা একে বলি “পকেট কেস”। এরকম পকেট কেস প্রতিদিন দু-একটা হয়। লোকজন পড়ালেখা জানে না তো তাই তার নামে কে কেস করল, কী কেস, সত্য না মিথ্যা জিজ্ঞাসা করার সাহস পায়না, টাকা-পয়সা দিয়ে কোন রকম বেঁচে যায়। 

 

টাকা না থাকলে কী করে সে ব্যবস্থাও আছে। বকা আর দাউদ ভাই জামিন নিয়ে রাখে। পরে গরু, ছাগল বিক্রি করে টাকা দেয়। কেন? বকা, দাউদ ভাইরা অন্যায়ভাবে ধরা বন্ধ করতে পারে না? আরে ভাই, ভালো কথা কইছেন, বন্ধ করলে ডেলি বাংলা আর মুরগীর মাংস চলবে কিভাবে? বাংলা আবার কী? জিজ্ঞাসা করতেই বললো শহরে থাকেন, বাংলা চেনেন না! বাংলা মদ, স্পিরিট আর পানি মিশিয়ে বিক্রি করে। প্রতিদিন গ্যালন আসে শহর থেকে, সন্ধ্যার পরে বাজারে থাকেন। দেখবেন কী এলাহিকাণ্ড। 

 

বললাম, পুলিশ কিছু বলে না। পুলিশরা সাথে বসে খায়? কথাগুলো হচ্ছিল সিনেমা হলের সামনে অসীতের চায়ের দোকানে বসে। সিনেমা দেখে, মদ খায়, অনেকের হাতেই টর্চ লাইট, এত টাকা পায় কোথায়? কেন মামলা-মোকদ্দমা মিমাংসা করে, পকেট কেস ছাড়ায়, ট্রেনের তেল নামায় আর ছোট খাট অনেক কিছুই করার থাকে বললে। আরও জানাল শুধু মদ না, সাথে নারীও থাকে। বললাম, গণ্যমান্য ব্যক্তিরা কিছু বলে না।ভালো কথা কইছেন, আজ-কাল কি বিচার-সালিশের দিন আছে, আর এদের কি কেউ মানে। কেউ কিছু বললে তারই বারটা বাজিয়ে দেয়। তাছারা অনেকেই তো মেম্বারের ছেলে, পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ী। তাছাড়া পুলিশের দোস্ত, এদের কে কি বলবে। এ অধঃপতনের কথা শুনে মনটা কেঁদে উঠল। এই কি আমার গ্রাম? 

 

মামলা-মোকদ্দমা মীমাংসা কিভাবে করে জানতে চাইলে ছেলেটি বললো, ‘ভাই একটা মুরগী মারলেও কোর্টে মামলা হয়, বিশ টাকা দিলেই তো মামলা করা যায়। যুক্তি-বুদ্ধি নিয়ে মামলা করায়ে তার পর উভয় পক্ষের থেকে টাকা খেয়ে মীমাংসা করায়। দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাঝে খান থেকে লাভবান হয় তৃতীয় পক্ষ দাউদ-বকাদের। অথচ নইমদ্দির ঘরের বেড়া কোটে তার মেয়ের ইজ্জত নষ্ট করল রজতবুদ্দিনের ছেলে তার কোন বিচার হয় নাই। কেন হলো না? ওনি সাহেবকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে নইমদ্দিনকে ভয়-ভীতি দেখায়ে আর পাঁচ হাজার টাকায় মীমাংসা করল। এ মেয়েটির কি বিয়ে হয়েছে? নষ্ট মেয়েকে বিয়ে করবে কে? 

 

তাহলে? এখন আর কি করবে-মাঝে মাঝে সাহেবরা এদিক-সেদিক নিয়ে যায়, হায়রে আমার গ্রাম। আর গ্রামের অবস্থা?  ব্রিটিশ নেই, জমিদারও নেই, পাকিস্তানও নেই, মাতব্বর প্রথাও নেই। সবই বিলুপ্ত হয়ে জন্ম হয়েছে যা, তা কতকাল চলবে কো জানে। কংকাল আর প্রতিবাদহীন অশিক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষগুলো কতদিন আর ভিলেজ টাউটদের দৌরাত্ম সহ্য করবে, কতদিন আর নরপিশাচ সাহেবদের লালসার খোরাক হবে দরিদ্র মা-বোনেরা, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা ঘরের খাদ্য-শস্য বিক্রি করে উলঙ্গ নৃত্য দেখতে সিনেমা হলে যাবে? নীরব নইমদ্দিনের মেয়েরা ধনীর দুলালের কাছে ইজ্জত হারিয়ে আর কতদিন সাহেবদের খোরাক হবে।

 

এর কোন প্রতিকার কি হবে না? গ্রাম বাংলার ক্রমবর্ধমান টাউটদের জন্ম আমরা কি ঠেকাতে পারব? বাংলার ঐতিহ্য গ্রামভিত্তিক সমাজ কি ভবিষ্যতে আমরা কুলষমুক্ত রাখতে পারব? নাকি মাদারে চাচা, নইমদ্দিন চাচা-যাদের প্রতিবাদের সামর্থ নাই, অন্যায়ের প্রতিকার যারা পায় না, সহজ-সরল ওই মানুষগুলো যারা একটা মাত্র বিড়ির আতিথেয়তায় ভোট দেয় তারা কি ধ্বংস হয়ে যাবে? দিন দিন আর টাউটের বংশ বৃদ্ধি পেয়ে পুরো গ্রাম বাংলা ছেয়ে যাবে শুধু টাউটে আর টাউটে।

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে