ঢাকাঃ সকালে ডেইলি স্টারে একটি নিউজ দেখে বাংলাদেশি হিসেবে নিজেকে খুব ধন্য মনে হল। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস মালয়েশিয়ার আলবুখারী আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের Chancellor নিযুক্ত হয়েছেন। উনাকে সে পদে পদায়ন করার মূল কারণ সেখানে ছাত্রদের মাঝে সামাজিক ব্যবসার মূল্যবোধ তৈরি করতে পারা। আমার ঠিক মনে নেই, বিশ্বের যে ৯০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. ইউনূস এর সামাজিক ব্যবসা বিষয়ে পড়ানো ও গবেষণা হয়, তার মধ্যে মালয়েশিয়ার এ বিশ্বিদ্যালয়টি রয়েছে কি না। হয়ত আছে। আমি ২০১৫ সালে সামাজিক ব্যবসা নিয়ে একটি সম্মেলনে মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম। মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সে কর্মশালার সমাপনী ভাষণে সামাজিক ব্যবসার জন্য ২০ মিলিয়ন রিঙ্গিট অনুদান দেন পাইলট প্রকল্পের জন্য সেখানকার কিছু সংস্থাকে। তারা গবেষণা করে দেখে যদি সফলতা পায় তবে সরকারের মূল কার্যক্রমে সামাজিক ব্যবসা অন্তর্ভুক্ত করবে। এ নিয়ে আমি আগেই একটি পোস্ট দিয়েছিলাম।
আমার আজকের লেখা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য। সামাজিক ব্যবসা বা সোশ্যাল বিজিনিস সম্পর্কে শুনছিলাম ২০১১-১২ থেকেই। কিছুটা আগ্রহ বাড়লো যখন আমার ছেলে ইমরান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ পড়ার সময় একটি এসাইনমেন্ট তৈরি করছিল তখন থেকে। তাদের বন্ধুরা অনেক বড় বড় multinational কোম্পানি নিয়ে লিখছে। কিন্তু সে বেছে নিল সোশ্যাল বিজনিজ। সে লিখতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে। গুগুল থেকে অনেক তথ্য নিয়েছে। নিয়েছে সোশালবিজিনিজেপিডিয়া থেকেও। আমাকে তার পাণ্ডুলিপি পড়তে দিল। পড়ে বেশ উৎসাহিত হলাম। আমার এক বন্ধু যে এক সময়ে আমার ফরেস্ট্রির ছাত্র ছিল, সে সে গ্রামীণ টেলিকমের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, তার কাছে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলাম। সে বলল, স্যার ইমরানকে আগামী সপ্তাহে আমাদের এখানে সোশ্যাল বিজনিজ ডিজাইন ল্যাবে যোগ দিতে বলেন। বলল, আগে কিন্তু অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। যোগদানের জন্য ফি হচ্ছে ২৫০/-। আমার নিজেরও জানতে ইচ্ছে হল। তাই দু'জনের জন্য ৫০০/- টাকা জমা দিয়ে সোশ্যাল বিজনিজ ডিজাইন ল্যাবে যোগদানের জন্য রেজিস্ট্রেশন করলাম। আমার বন্ধু মনজুর এর কাছ থেকে জানতে চাইলাম রেজিস্ট্রেশন ফি কেন নিল? বলল, মিটিংয়ে যে খাওয়া সার্ভ করা হয় (চা নাস্তা ও লাঞ্চ)এর মূল্য। কিছুটা অন্য রকম। আমরা কোন মিটিংয়ে গেলে বিনা পয়সায় খাই। আবার একটি হলুদ খামে কিছু টাকাও পাই। আর এখানে টাকা দিয়ে যোগদান করতে হবে। যাক, যথারীতি মিটিংয়ে গেলাম। ড. ইউনূস মিটিং চেয়ার করছেন। প্রায় দু'শ জন পার্টিসিপ্যান্ট। এরমধ্যে বেশ কয়েকজন বিদেশি। ইংরেজিতেই আলোচনা চলছিল। আমি কয়েকটি বিষয়ে ইন্টারেক্ট করাতে আমাকে ড. ইউনূস অনুরোধ করলেন আমি যেন কিছু আলোচনা বাংলায় ট্রান্সলেট করে দেশীয় অংশগ্রহণকারীদের বুঝতে সহায়তা করি । আমিও উৎসাহ নিয়ে active পার্টিসিপ্যান্ট হয়ে গেলাম। সেদিনই একটা বড় পরিবর্তন এসে গেলো মিটিংয়ে। সিদ্ধান্ত হল পরবর্তী সব মিটিংয়ের আলোচনা বাংলায় হবে। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। আমার কাজ হবে কারিগরি তথ্য দিয়ে সহায়তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণকারীদের জন্য লাইভ স্ট্রিমে ইংরেজিতে মূল আলোচনার সারসংক্ষেপ শেয়ার করা। এ দায়িত্ব পড়ে গেল আমার ওপরে। সবার কাছে আমি বেশ পরিচিত হয়ে গেলাম। বিদেশে অনেকে আমাকে দেখে বলে, তোমাকে আমি দেখেছি। তুমি না লাইভ স্ট্রিমে সোশ্যাল বিজনিজ বিষয়ে বলো। বেশ ভালোই লাগে তখন।
বিভিন্ন উদ্যোক্তা তাদের ব্যবসা প্রস্তাব বাংলায় উপস্থাপনা করার পর আমি তা ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিদেশিদের ও লাইভ স্ট্রিমে বিশ্বের ৮০টি দেশের অংশগ্রহণকারীদের আলোচনার সারমর্ম উপস্থাপন করতে সহায়তা করলাম। বলা যায়, পরবর্তীতে এ দায়িত্ব আমার ওপরই চাপে।
আবার ফিরে আসি, সেই সোশ্যাল বিজনিজ নিয়ে ইমরানের কি ধারণা হলো, জানতে চাইলাম। সে বলল, দুটি বিষয় তাকে মুগ্ধ করেছে। প্রথমত: ওদের প্রচলিত পড়াশুনা সত্যিই wealth concentration সহায়ক। সারা বিশ্বের ৯৫% সম্পদের মালিক মাত্র চার-পাঁচ জন। আমাদের চাকুরী তাদের আরও বড়লোক হওয়ার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। দ্বিতীয়ত: সামাজিক ব্যবসার মূলমন্ত্র হচ্ছে যাদের অতিরিক্ত সম্পদ রয়েছে, তাদের সম্পদের একটি অংশ যেন লাভের কথা বিবেচনা না করে সমাজের একটি সমস্যা সমাধানে বিনিয়োগ করে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ বিনিয়োগ বিনা সুদে বা লাভে বিনিয়োগকারী ফেরত নিবেন। এটি চ্যারিটি নয়।
এত আলোচনা থেকে ইমরান যে দুটি বিষয় নিয়ে আসলো তা আমার খুব ভালো লাগলো। ইমরান বলল, এতো অনেকটা ইসলামিক পদ্ধতির কর্যে হাসানার মতো। টাকা ধার দেবেন। নির্দিষ্ট সময় পর বিনা লাভে টাকাটা ফেরত নেবেন।
আমার তখনই মিল্লাতের মায়ের কথা মনে পড়লো। মিল্লাত আমার বন্ধু। ফরেস্ট্রির ছাত্র। আমরা একসাথে বিলেতে পড়াশোনা করেছি। ও পিএইচডি করছিল। আমি কিরছিলাম এমএস। মিল্লাত আমার ছাত্রও বটে। ওর কাছে ওর মায়ের অনেক গল্প শুনতাম। ওর মা লাকসাম থাকতেন। গ্রামের বাড়িতে। উনার ছেলে মেয়েরা যাকাত হিসেবে বণ্টনের জন্য যে টাকা দিতেন, উনি তা কর্যে হাসানা হিসেবে বিভিন্ন কর্মসৃষ্টির কাজে বিনিয়োগ করতেন। কেউ রিকশা কেনার জন্য, কেউ জমি লিজ নেয়ার জন্য, কেউ বাড়ির টিন লাগাতে, কেউ একটি দুধের গরু কিনতে, ইত্যাদির জন্য বিনা সুদে টাকা ধার দিতেন। নির্দিষ্ট সময়ে টাকা ফেরত নিয়ে আরেকজনকে দিতেন। সবাই টাকা ফেরত দিচ্ছেন তা নয়। কেউ ফেরত দিয়েছে। কেউ দিতে পারে নি, তা নিয়ে উনার কোন অভিযোগ নেই। এভাবে উনি গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংক নামে পরিচিতি লাভ করেন। যে কোন সমস্যায় সবাই উনার কাছে যায়। উনি তা সমাধানের চেষ্টা করেন। হঠাৎ মনে হল, উনিতো অনেক আগে থেকেই সোশ্যাল বিজনিজ করছেন। খালাম্মার সাথে আমার একবার এ নিয়ে অনেক গল্প হলো। আমার আগের একটি লেখাতে সে গল্প লিখেছিলাম। উনি এ টাকা শুধু মুসলিমদের দিয়েছেন তা নয়, যে কোন ধর্মের মানুষকে টাকা ধার দিয়েছেন। সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছেন। তবে উনার কথা একটিই, টাকা দিয়ে টাকা ফেরত পাওয়া খুব সহজ কাজ নয়। অনেকে ব্যবসার পুঁজি হিসেবে উনার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছেন।ব্যবসায় সাফল্য আসলেও সবাই টাকা ফেরত দেয় নি। উনি তার জন্য কোন আক্ষেপ করেন নি।
ফিরে আসি সেই সোশ্যাল বিজনিজ ল্যাব এর মিটিংয়ে। অনেক তরুণ উদ্যোক্তা তাদের ব্যবসা প্রস্তাব পেশ করলো। সব প্রস্তাব নিয়ে দেশি বিদেশি অংশগ্রহনকারীগণ আলোচনা করে প্লেনারী সেশনে আসলো। কেউ প্রস্তাব দিল বিনিয়োগে, কেউ বা উৎপাদিত পণ্য কিনতে। এ এক মহা উৎসবের মতো। এক লক্ষ টাকার ব্যবসা প্রস্তাব আলোচনায় দশ লাখ টাকার প্রস্তাবে পরিনিত হল। আবার কখনও কোটি টাকার প্রস্তাব ২০-২৫ লক্ষ টাকায় নেমে এলো। এ ব্যবসা হয় যৌথ ব্যবসা। উদ্যোক্তা আর ইউনূস সেন্টার মিলে ব্যবসা। লাভ লোকসান ইউনূস সেন্টার ও উদ্যোগী ভাগ করে নেবে। পরবর্তীতে যদি ব্যবসা দাঁড়িয়ে যায়, তবে উদ্যোক্তা তার নিজের নামে ব্যবসা নিয়ে নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাকে পুঁজির ২০% টাকা ইউনূস সেন্টারকে দিতে হবে।
জানিনা আমরা কতজন জানি। সম্প্রতি শুনলাম সোশ্যাল বিজনিজে দেশ বিদেশে ইউনূস সেন্টারের বিনিয়োগ প্রায় ৮০ মিলিয়ন ডলার। বিশ্বের ৯০টি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।
এবার আসি আমার নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে। সোশ্যাল বিজনিজ সম্পর্কে motivated হয়ে মিল্লাতের মায়ের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে আমি আমার ভাই বোনদের অনুরোধ করলাম আমাকে যেন সবাই তাদের পক্ষ থেকে কিছু টাকা দেয়। আমি সোশ্যাল বিজনিজ হিসেবে সে টাকা বিনিয়োগের চেষ্টা করবো। সবাই আমাকে সহায়তা দিল। আমিও বিনিয়োগ করলাম। আমি মিল্লাতের মায়ের মতোই বলি, টাকা ধার দিয়ে ফেরত আনা সবচেয়ে কঠিন কাজ। টাকা দেয়ার সময় নিজেকে রাজার মতই মনে হত। যখন বলতাম তোমার টাকা ফেরত দিতে দেরি হচ্ছে কেন? কত অজুহাত! তবুও কিছু সফলতা দেখে আনন্দে মনটা ভরে উঠতো। কয়েকজনকে শিক্ষা ঋণ দিয়েছিলাম। পাস করে চাকুরিও করছে। কিন্তু টাকা নাকি যা পায় তা দিয়ে কোন মতে তার সংসার চলছে। ফেরত দেয়ার মত হচ্ছে না। মনে হল, এ কাজ ব্যক্তি পর্যায়ের নয়। প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। প্রয়োজন কঠিন আইনি প্রক্রিয়ার। নইলে এর সফলতা আসবে না। বিদেশে এর অভিজ্ঞতা শুনার আগ্রহ আছে। অপেক্ষায় আছি। শুনেছি ভারত, ভিয়েতনাম, হংকংহ, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সামাজিক ব্যবসায় বেশি সাফল্য অর্জন করেছে। আগামীতে এ বিষয়ে লিখবো।