Dr. Neem on Daraz
Victory Day

পাঁচজন নারী যেভাবে ফিনল্যান্ড চালাচ্ছেন


আগামী নিউজ | আন্তর্জাতিক ডেস্ক প্রকাশিত: নভেম্বর ২৬, ২০২০, ০২:১০ পিএম
পাঁচজন নারী যেভাবে ফিনল্যান্ড চালাচ্ছেন

ঢাকাঃ ফিনল্যান্ডে সর্বকনিষ্ঠ এক নারী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার গঠনের এক বছর পার হতে যাচ্ছে। তার জোট সরকারে যে পাঁচটি দল আছে তার সবগুলোর প্রধানও নারী।

করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় তাদের শান্ত ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সেদেশে প্রশংসিত হচ্ছে। একই সঙ্গে এই সরকার লিঙ্গ সমতার ব্যাপারে উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি কর্মসূচিও গ্রহণ করেছে যাতে বলা হয়েছে যে প্রত্যেক নাগরিকেরই তাদের নিজেদের লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণের অধিকার রয়েছে।

ফিনিশ প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিনের অফিস থেকে হাউজ অফ এস্টেটের দূরত্ব দুশো মিটারের মতো যেখানে তিনি তার সরকারের গৃহীত এক প্রোগ্রামের এক বৈঠকে সভাপতিত্ব করতে যাচ্ছেন। ইকুয়ালিটি প্রোগ্রাম নামের এই কর্মসূচি তার সরকারের একটি প্রধান কর্মসূচি।

ছোট খাটো বিষয়ে কথা বলার মতো মুডে তিনি নেই। কিন্তু হানিমুনের পর তার মতো আর কে এরকম কাজ করতে আসবে? এই অগাস্ট মাসে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে হঠাৎ করে সন্তানের পিতার সঙ্গে সান্না মারিনের বিয়ে হয়েছে। এর পর তারা অজ্ঞাত একটি স্থানে কিছুদিন ছুটিও কাটিয়েছেন।

এর মধ্যে সান্না মারিনের ব্যক্তিগত ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে তার একটি ছবি পোস্ট করা হয়েছে যাতে তিনি ঐতিহ্যবাহী ফ্যাশনের লম্বা-হাতার বিয়ের রেশমি পোশাক পরে তার স্বামী, সাবেক পেশাদার ফুটবলার এবং তার ১৬ বছরের সঙ্গী মার্কুস রাইক্কোনেনকে জড়িয়ে ধরেছেন। এর আগে তিনি তার কন্যা এম্মাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন একটি ছবিও সোশাল মিডিয়াতে শেয়ার করেছিলেন।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে এই দম্পতির মুখে প্রশস্ত হাসি। তারা একে অপরকে দু'হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছেন। তাদের পেছনে রাজধানী হেলসিঙ্কিতে প্রধানমন্ত্রীর অপূর্ব সুন্দর সরকারি বাসভবন কেসারান্তা। বাল্টিক সাগরের তীরে কাঠের অলঙ্কার করা এই ভিলাতেই তারা থাকেন।

রাজনৈতিক সম্পাদক থেকে শুরু করে ফ্যাশন ব্লগার, পডকাস্টার এবং স্কুলের শিক্ষার্থীরাও খুব দ্রুত সান্না মারিনের এই ছবিটি শেয়ার করে।

হাউজ অফ এস্টেট, যেখানে জোট সরকারের নেতারা রুদ্ধদ্বার কক্ষে বৈঠক করবেন, তার সামনে বহু সাংবাদিক অপেক্ষা করছেন।

প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন বলেন, "আমি তাদেরকে (সাংবাদিকদের) কী বলবো সে বিষয়ে আমি কোন প্রস্তুতি নেই না।" এসময় একজন নারী দেহরক্ষী তার পেছনে হেঁটে যাচ্ছিলেন। "তারা আমাকে যে কোন কিছু জিজ্ঞেস করবে এবং আমি সততার সঙ্গে সেগুলোর উত্তর দেব।"

এ সপ্তাহে হয়তো তার ব্যক্তিগত কিছু বিষয়েও তাকে প্রশ্ন করা হতে পারে?

"না। তারা বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চায়। এখানে তো অনেক কিছুই হচ্ছে," জবাব দিলেন সান্না মারিন, "হয়তো তারা শেষের দিকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে।"

কোন কোন সাংবাদিক মুখে মাস্ক পরে আছেন। কারো কারো হাতে লম্বা লাঠির মাথায় মাইক বাঁধা।

বৈঠকে যোগ দিতে রাজনীতিবিদদের মধ্যে সবার আগে এলেন সান্না মারিন। এবং তিনি ঠিকই বলেছিলেন- ফিনিশ সাংবাদিকরা বিভিন্ন বিষয়ে তার কাছ থেকে জানতে চাইলেন।

এর পর চার ঘণ্টা ধরে বৈঠক হল। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য তিনি আবার বাইরে বের হয়ে এলেন।

রাজনীতিবিদদের মধ্যে তিনিই সবার শেষে বৈঠক ছেড়ে গেলেন।

সান্না মারিনের প্রথম যে ছবিটি ভাইরাল হয়েছিল সেটি তোলা হয়েছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার প্রথম দিনে।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে ফিনল্যান্ডের নতুন ও সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন, সেসময় তার বয়স ছিল ৩৪ বছর, হাসি মুখে অন্যান্য রাজনীতিবিদদের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। এই রাজনীতিবিদরাই তার মধ্য-বাম জোট সরকারের নেতৃত্ব দেবেন।

তাদের সবাই নারী। এই ছবিটি যখন ছাড়া হয়েছিল, সেসময় পাঁচ-দলীয় জোট সরকারের মাত্র একজন নেতার বয়স ছিল ৩৪ বছরের উপরে।

মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে সান্না মারিন সেদিন ফটো-সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে তিনি ফিনল্যান্ডের তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছেন। এসময় তিনি আন্তর্জাতিক মিডিয়ারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "আমরা ফিন্সরা কেমন সারা বিশ্বের সামনে তা তুলে ধরার এটাই সুযোগ।"

এই বার্তাটি সেসময় সনাতন রাজনীতির বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল।

রেজ এগেইন্সট দ্য মেশিন ব্যান্ডের গিটারিস্ট টম মোরেলো তার ইনস্টাগ্রাম পেজে নতুন জোট সরকারের নেতাদের একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন এই আমেরিকান রক ব্যান্ডের একজন ভক্ত। এই পোস্টে লাইকও দিয়েছিলেন সান্না মারিন।

সেখানে কিছু সেক্সিস্ট মিম বা ছবিও ছিল। তার একটি ছিল এরকম: সাওনায় একসঙ্গে স্নান করতে করতে নারীরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

নানা দিক থেকেই ফিনল্যান্ড এধরনের কোয়ালিশনের জন্য প্রস্তুত ছিল। নারীবাদের বিবেচনায় কোনো দেশকে যদি 'ওয়ান্ডারওম্যান আইল্যান্ড' বলা হয় তাহলে সেটি হবে এই ফিনল্যান্ড।

বিশ্বে ফিনল্যান্ডই প্রথম দেশ যেখানে ১৯০৬ সালে নারীদের ভোট ও সংসদীয় নির্বাচন- এই দুটো অধিকারই দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমের বেশিরভাগ দেশই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এতোটা অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি।

এর পরের বছর ১৯ জন নারী পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে ফিনল্যান্ডে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তারিয়া হালোনেন। এর পর ২০০৩ সালে আন্নেলি ইয়াত্তেনমেকি নির্বাচিত হন প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।

বিবিসি ১০০ নারী
এর পর ২০১৯ সালের শেষের দিকে আরো একজন নারী প্রধানমন্ত্রী হলেন সান্না মারিন। তার মধ্য-বামপন্থী দল সোশাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি তাকে দলের নেতা হিসেবে নির্বাচিত করলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর আগে ডাক-ধর্মঘট সামাল দিতে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়লে প্রধানমন্ত্রী আন্তি রিন্নে পদত্যাগ করলে সান্না মারিন নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

তিনি দেশটির সর্বকালের সর্বকনিষ্ঠ নেতা।

বিবিসি ২০২০ সালের প্রভাবশালী নারীদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তার একজন এই ফিনিশ প্রধানমন্ত্রী- সান্না মারিন।

তার দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় তিন মাস পর ১১ই মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ এর প্রকোপকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু ভাইরাসটি যখন ফিনল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছাল তখন তার জন্য প্রস্তুত ছিল সান্না মারিনের সরকার।

১৬ই মার্চের মধ্যে দেশটিতে লকডাউন জারি করা হল। একই সঙ্গে করা হল জরুরি ক্ষমতা আইন বা ইমার্জেন্সি পাওয়ার্স অ্যাক্ট। এই আইনটি সবশেষ প্রয়োগ করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। এই আইনে লোকজনের মজুরি নিয়ন্ত্রণ এবং শ্রমের জন্য লোকবল নিয়োগে সরকারকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়।

সরকারের এই উদ্যোগ সংবাদ মাধ্যমে সমালোচিত হলেও জনমত জরিপে দেখা গেছে যে এর পেছনে লোকজনের সমর্থন রয়েছে।

এসময় ফিনল্যান্ডের জনগণকে পরিষ্কারভাবে একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল: যতোটা সম্ভব ঘরে থাকুন। যাদের শরীরে মৃদু উপসর্গ দেখা দিবে পরীক্ষা করানোর জন্য তাদেরকে উৎসাহিত করা হল। সমন্বিত পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করার জন্য ল্যাবরেটরি, ডাক্তার এবং ক্লিনিকগুলোর মধ্যে অনলাইনে নিয়মিত বৈঠকের ব্যবস্থা করা হল।

প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন এবং জোট সরকারের নেতৃস্থানীয় তার চারজন সহযোগী প্রতি সপ্তাহে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি তুলে ধরতে শুরু করলেন। এসময় তারা সাংবাদিক ও দেশের সাধারণ নাগরিকদেরও প্রশ্নের উত্তর দিতেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি শিশুদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতেন।

এসব কারণে সান্না মারিন ব্যাপক প্রশংসিত হলেন এবং তার নাম তাইওয়ান, জার্মানি ও নিউজিল্যান্ডের সরকার প্রধানের কাতারে স্থান পেল। অনেকেই বলতে লাগলেন- তাহলে কি নারী নেতারাই সঙ্কট ভালভাবে সামাল দিতে পারেন!

বিবিসির কাছে এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন সান্না মারিন নিজেই: "পুরুষরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন দেশও তো আছে যারা ভাল করেছে।"

"সুতরাং আমি মনে করি না যে এখানে নারী পুরুষের কোন ব্যাপার আছে। আমার মনে হয় যেসব দেশ ভাল করেছে তাদের কাছ থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি সেদিকেই আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত।"

ফিনল্যান্ডের জনসংখ্যা ৫৫ লাখ। এপর্যন্ত করোনাভাইরাসে মৃত্যু ৩৭০ জনের কিছু বেশি। প্রতি দশ লাখ মানুষে এই মৃত্যুর হার ৬০। ব্রিটেনে এই মৃত্যুর হার ফিনল্যান্ডের তুলনায় ১০ গুণ বেশি।

"ফিনল্যান্ডে আমরা যে অল্প কিছু বিষয় শিখেছি তার মধ্যে রয়েছে- বিজ্ঞানীদের কথা শোনা খুব গুরুত্বপূর্ণ, আমরা যাতে সব ধরনের জ্ঞান ব্যবহার করতে পারি, যখন অনিশ্চয়তা দেখা দিবে তখন দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে," বলেন সান্না মারিন।

"আমাদের এমন এক সমাজ যা আস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত। জনগণ সরকারকে বিশ্বাস করে, গণতান্ত্রিক আদেশের প্রতিও তাদের আস্থা রয়েছে।"

জরুরি আইনের আওতায় যেসব বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল সেগুলো পরিকল্পিত সময়ের অনেক আগেই, জুন মাসে, প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সান্না মারিনের জোট সরকার এর মধ্যে বড় ধরনের ধাক্কা খায় যখন অর্থ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং সেন্টার পার্টির নেত্রী, জোট সরকারের সর্বকনিষ্ঠ নেতা, ৩৩ বছর বয়সী কাত্রি কুলমুনি পদত্যাগ করেন। সেপ্টেম্বর মাসে তার পদে স্থলাভিষিক্ত হন আরেকজন নারী- আন্নিকা সারিক্বো।

বাইরের দিক থেকে বর্তমান জোট সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দেখালেও সরকারের ভেতরে মতবিরোধও কিন্তু আছে।

"কোন দল শুধু তাদের নিজেদের মতো করে দেশ চালাতে পারে না," বলেন শিক্ষামন্ত্রী এবং লেফট অ্যালায়েন্স দলের নেতা ৩৩ বছর বয়সী লি আন্ডেরসন।

"মাঝে মধ্যে এধরনের উত্তেজনা তৈরি হবে। দরজার পেছনে আপস-রফার মাধ্যমে সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। কারো কারো এধরনের কথা বলার প্রবণতা আছে যে আপনি একজন নারী তাই আপনি এক ধরনের নীতিমালা তৈরি করবেন, অথবা আপনারা সবাই নারী তাই আপনাদের পক্ষে একমত হওয়া সহজ ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে কিন্তু সেরকম কিছু নয়।"

সান্না মারিন বলেন, তিনি যখন কিশোরী ছিলেন তখন তিনি কল্পনাও করেন নি যে স্বামী ও দুই বছর বয়সী কন্যা এম্মাকে সাথে নিয়ে তিনি কেসারান্তায় বসবাস করবেন।

"রাজনীতিবিদ ও রাজনীতিকে আমার অনেক দূরের বিষয় বলে মনে হতো। আমি যে পরিবেশে ছিলাম তার চেয়ে এই জগত একেবারেই আলাদা," বলেন তিনি।

"অন্যান্য ফিনিশ পরিবারের মতো আমার সংসারেও অনেক দুঃখের গল্প আছে," ২০১৬ সালে তিনি তার ব্যক্তিগত ব্লগে এই মন্তব্য করেছিলেন।

সান্না মারিন ফিনল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ছোট্ট একটি শহর পির্ককালায় তার মা ও মায়ের এক বান্ধবীর কাছে বড় হয়েছেন।

তিনি তার পরিবারকে বলেন "রংধনু পরিবার," যদিও তারা আর্থিক সঙ্কটে ছিলেন।

সান্না মারিনের মা বড় হয়েছেন একটি অনাথ আশ্রমে। তিনি তার মাদকাসক্ত স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার পর তারা সরকারি ভাতার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।

খুব অল্প বয়স থেকেই সান্না মারিন খুচরা দোকানে কাজ করতেন তার পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করার জন্য।

তিনি যে একদিন খুব বড় কিছু হবেন সেরকম কোন সম্ভাবনাও ছিল না। পির্ককালা হাই স্কুলে তার শিক্ষক পাসি কেরভিনেন বলেন সান্না মারিন "একজন সাধারণ মানের ছাত্রী" ছিলেন। তবে তিনি জানিয়েছেন সান্না মারিনের বয়স যখন ১৫ তখন তিনি তার গ্রেডের উন্নতির জন্য শিক্ষকদের কাছে বাড়তি হোমওয়ার্ক চাইতেন।

সান্না মারিন রাজনীতির ব্যাপারে সচেতন হন তার বয়স যখন কুড়ির ঘরে। তিনি বলেন, এই সময় তিনি শুধু তার নিজের জন্য নয়, আশেপাশের মানুষের পরিস্থিতির উন্নতির কথাও ভাবতে শুরু করেন।

সান্না মারিন সরকারের ইকুয়ালিটি প্রোগ্রামের মধ্যে রয়েছে পরিবারের পিতা-মাতা যাতে সমানভাবে দায়িত্ব ভাগ করে নেন সেবিষয়ে তাদেরকে উৎসাহিত করা, পারিবারিক সহিংসতা কমানো, নারী ও পুরুষের বেতনের বৈষম্য হ্রাস এবং দরিদ্র ও অভিবাসী পরিবারের শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা।

এই সরকারের আরো কিছু পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে ট্রান্স অ্যাক্ট সংস্কার করা। বর্তমানে কেউ যদি আইনগতভাবে তার লিঙ্গ নির্ধারণ করতে চান তাহলে এই আইন অনুসারে কয়েক বছর ধরে তার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন বলেন, "প্রত্যেকেরই তার নিজের পরিচয় নির্ধারণের অধিকার থাকা উচিত। এবং এই প্রোগ্রামে সেটাকেই সমর্থন করা হয়েছে।"

ট্রান্স বা পরিবর্তনকামী নারীদেরকে কি তিনি নারী হিসেবে বিবেচনা করেন?

"লোকজনকে চিহ্নিত করা আমার কাজ নয়। প্রত্যেকের নিজের পরিচয় নির্ধারণ করার কাজ তার নিজের। আমার তো এখানে কিছু বলার নেই।"

একজন মানুষ নিজেই তার লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণ করবে- এধরনের খোলামেলা অবস্থান সরকার প্রধান হিসেবে সারা বিশ্বে তিনিই হয়তো প্রথম দিলেন।

ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার নিয়ে যারা আন্দোলন করছেন তারা "সেকেলে" ট্রান্স অ্যাক্ট সংস্কারের দাবিতে কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাদের কারো কারো সন্দেহ আছে সান্না মারিনের সরকার শেষ পর্যন্ত সেরকম কিছু করতে পারবে কীনা।

"অতীতের সব সরকারই এই আইনটি পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীলদের চাপের মুখে সেখান থেকে পিছু হটেছে," বলেছেন অ্যাক্টিভিস্ট কাসপার কিভিস্তো। এবিষয়ে তার পরামর্শের কথা জানাতে ইতোমধ্যে তিনি জোট সরকারের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন।

"আমাদের দেশে এখন সর্বকনিষ্ঠ নারী নেত্রী। এটি একটি দিক মাত্র। সত্যিকার অর্থে একটা পার্থক্য তৈরি করার জন্য তার পেছনে যে ব্যবস্থা বা সিস্টেম আছে তাদের কাছ থেকে সমর্থন প্রয়োজন," তিনি বলেন।

কিন্তু এবারের জোট সরকারে যে পাঁচটি দল আছে তাদের সবাই এই আইনের সংস্কারের পক্ষে। এবিষয়ে একটি বিল আগামী বছরে পার্লামেন্টে পেশ করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

"ফিনল্যান্ডে সবসময়ই জোট সরকার ক্ষমতা ছিল। ফলে আপসের চেষ্টা করার ব্যাপারে আমরা অভ্যস্ত। বিভিন্ন দল আর মতাদর্শের মধ্যে আমরা মিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি," বলেন প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন।

"আমি মনে করি এটা আমাদের একটা শক্তি। কিন্তু এর ফলে যে সবকিছুই দ্রুত গতিতে করে ফেলা যায় তা নয়।"

এপ্রিলে করা এক জরিপে দেখা গেছে সান্না মারিন যেভাবে করোনাভাইরাস মহামারি সামাল দিচ্ছেন তার প্রতি ৮৫% মানুষের সমর্থন রয়েছে। তারপরেও মারিন বলেছেন যে তিনি এসব জরিপের দিকে তাকান না।

তবে তার সমালোচনাও রয়েছে। সারা বিশ্বে যখন কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারের ব্যাপারে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন চলছে সেসময় কৃষ্ণাঙ্গ কিছু ফিনিশ সোশাল মিডিয়ায় সরকারের সমালোচনা করে বলেছেন, ফিনিশ সরকারের পরিকল্পনায় নানা ধরনের অসাম্য দূর করার কথা বলা হলেও বর্ণ-বৈষম্যের বিষয়ে তেমন কিছু করা হয়নি।

কাউন্সিল অফ ইউরোপের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডে আগত কৃষ্ণাঙ্গদের ৬৩% নিয়মিত বর্ণবাদী হয়রানির শিকার হন। ইউরোপে দেশগুলোর মধ্যে ফিনল্যান্ডের এই হার সর্বোচ্চ।

ফিনল্যান্ডের পার্লামেন্টে বর্তমানে মাত্র একজন নারী কৃষ্ণাঙ্গ এমপি। তার নাম বেল্লা ফর্সগ্রেন।

গ্রিন লিগ পার্টির নেতা ৩৫ বছর বয়সী মারিয়া ওহিসালো বলেছেন যারা বলেন যে জনজীবনে বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করার জন্য সরকারের আরো কিছু করা দরকার তাদের সঙ্গে তিনি একমত।

"সরকারের নেতৃত্বে পাঁচজন শিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ নারী কিন্তু শেষ পর্যন্ত খুব বেশি প্রতিনিধিত্বশীল নয়। আমরা যদি এক্ষেত্রে সমতার দিকে তাকাই, তাহলে কিন্তু সেটা পাওয়া যাবে না," বলেন তিনি।

"আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড অবশ্যই একটা প্রভাব ফেলছে এবং এরকম হওয়া উচিত নয়," বলেন প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন। কিন্তু এই সমস্যা সমাধান করা তো আর তার কাজ নয়, বলেন তিনি।

ফিনিশ প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন এর ফলে জাতিগত সংখ্যালঘুদের অবস্থানের উন্নতি ঘটবে।

"এই প্রোগ্রামকে আমরা কীভাবে বাস্তবে পরিণত করতে পারি সেদিকে আমাদের সবাইকে মনোযোগ দিতে হবে। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটাই আমার ব্রত।"

আগামীনিউজ/প্রভাত

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে