Dr. Neem on Daraz
Victory Day
ইতিহাসের পাতা থেকে,

বিশ্বে প্রথমবারের মত কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত সৃষ্টি


আগামী নিউজ | ডেস্ক রিপোর্ট প্রকাশিত: নভেম্বর ১৭, ২০২০, ০১:০৪ পিএম
বিশ্বে প্রথমবারের মত কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত সৃষ্টি

ছবি: সংগৃহীত

কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত করার বিষয়টি প্রথম মাথায় আসে মার্কিন বিজ্ঞানী ভিনসেন্ট শায়েফার। তিনিই সর্বপ্রথম প্রকৃতির মেঘকে মানুষের হাতে বৃষ্টিতে রূপান্তর করেন ১৯৪৬ সালের ১৩ নভেম্বর।

১৮৯১ সালে লুই গাথমান প্রথম কৃত্রিম বৃষ্টি সৃষ্টিতে তরল কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহারের প্রস্তাব করেন। ১৯৩০ এর দশকে বার্গারন-ফাইন্ডিসেন বরফের স্ফটিক কণার উপস্থিতিতে অতীব ঠাণ্ডা পানির কণা জমে এবং শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি হয়ে নামে- এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে তত্ত্ব তৈরি করেন। এ তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেন জেনারেল ইলেকট্রিকের গবেষক ভিনসেন্ট শিফার। ১৯৪৬ সালের জুলাইতে তিনি কৃত্রিম বৃষ্টির মূলনীতি আবিষ্কার করেন। পরে  নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী আরভিং ল্যাংমুর সঙ্গে যৌথভাবে কৃত্রিম বৃষ্টি সৃষ্টির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন।

মার্কিন বিজ্ঞানী ভিনসেন্ট শায়েফার এবং নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ল্যাংমুর একসঙ্গে কৃত্রিম বৃষ্টি সৃষ্টি করার পন্থা বের করার কথা ভাবলেন। তারা বিভিন্ন পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখেন যে, বৃষ্টি সৃষ্টি হতে যে পরিমাণ ‘শীতলতা’ দরকার বায়ুমণ্ডলের বাষ্পকে মেঘে রূপান্তরিত করতে সে পরিমাণ শীতল যন্ত্র না থাকলে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তখনকার সময় ভিনসেন্ট জানতেন ‘ড্রাই আইস’ নামক কঠিনিত কার্বন ডাই-অক্সাইডের গুড়ো অনেক ঠাণ্ডা। তিনি পরীক্ষায় ড্রাই আইস ব্যবহার করলেন।

ভিনসেন্ট কৃত্রিম মেঘ বানাতে ব্যবহার করেছিলেন জমাট বাঁধা কার্বন ডাই অক্সাইড-এর টুকরো। এবং অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন সেখানে সৃষ্ট পদার্থ আলোর দারুণ প্রতিফলন করছে। তিনি বুঝতে পারলেন এখানে বরফের কেলাসের সৃষ্টি হয়েছে যা পরিষ্কারভাবে ল্যাম্পের আলোর প্রতিফলন দিচ্ছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভাবন করে ফেলেন অতি শীতল করার দারুণ এক উপায়। ভিনসেন্ট বার্কশায়ার পাহাড়ের কাছে ড্রাই আইস ছুঁড়ে দিয়ে তুলোর মতো মেঘ বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সর্বপ্রথম প্রকৃতির মেঘকে মানুষের হাতে বৃষ্টিতে রূপান্তর করা হয় ১৯৪৬ সালের ১৩ নভেম্বর। সেদিন শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, সারা বিশ্ব অবাক হয়েছিল।

ড্রাই আইস

খুব সহজে বললে, শুষ্ক কার্বন-ডাই-অক্সাইডের কঠিন রূপকেই ড্রাই আইস বলা হয়। অনেক কম তাপমাত্রায় এবং কম চাপে (−56.4 °C তাপমাত্রা এবং 5.13 atm চাপে) গ্যাসীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে রেখে দিলে সেটি তরলে রূপান্তরিত হয় না। তখন সরাসরি কঠিন পদার্থের আকার ধারণ করে। এই কঠিন পদার্থটিই হচ্ছে ড্রাই আইস।

ড্রাই আইসকে যখন উষ্ণ ও গরম পানির সংস্পর্শে আনা হয়, তখন মেঘের মত দেখতে শুভ্র ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। এই সাদা ধোঁয়াটি কিন্তু কার্বন-ডাই-অক্সাইড নয়, অধিক ঘনমাত্রার পানির বাষ্পের সঙ্গে মিশ্রিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড। বিষয়টি হচ্ছে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডার ফলে গরম পানির বাষ্প ঘনীভূত হয়ে এমন আকার ধারণ করে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাহিত এই কুয়াশাটা অনেক ভারি হয়। তাই এটি পাত্রের নিচে জমা হয়। পরে দেখা যায় এটি ফ্লোর ঘেঁষে ঘেঁষে উড়ছে।

ড্রাই আইস আমরা প্রতিদিনই ব্যবহার হয়। রাস্তায় যেসব গাড়িতে করে আইসক্রিম বিক্রি করা হয়, সেখানেও সংরক্ষণের জন্য ড্রাই আইস ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া হিমাগারে জিনিসপত্র সংরক্ষণে এবং জাহাজে করে দূরে পচনশীল পণ্য প্রেরণ করতে এটা ব্যবহৃত হয়। তবে ভুলেও খালি হাতে ড্রাই আইস হাতে নেবেন না। কেননা এটি এতই ঠাণ্ডা, চামড়ার অনেক ক্ষতি হবে।

কৃত্রিম মেঘ ও বৃষ্টি আবিষ্কারের নেপথ্যে

কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি নামানোর ক্ষেত্রে উপায় দুইটি। একটি হচ্ছে ভূমি থেকে কামান বা কোনো নিক্ষেপকের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলের ট্রপোস্ফিয়ার এলাকায় ঘনীভবনকারী পদার্থ ছুড়ে দেয়া। কিংবা ভূমি থেকে এমন কোনো ব্যবস্থা তৈরি করা, অনেকটা ধোঁয়ার মতো রাসায়নিক পদার্থগুলোকে ধীরে ধীরে ওপরে পাঠানো। এই পদ্ধতিতে প্রথমে বাহকের মাঝে রাসায়নিক ভরা হয়। যেহেতু এটি রকেটের মতো করে ছুঁড়ে মারা হবে তাই ওড়ার জন্য বাহককেও রকেটের মতো করে বানানো হয়। সেই রকেট একটি কামানের মতো নিক্ষেপক যন্ত্রের মাঝে রাখা হয়। পরে দিক ও লক্ষ ঠিক করে ছুড়ে মারা হয় ওপরে।

কৃত্রিম বৃষ্টির এই প্রক্রিয়া যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। সে কারণে ধনী দেশগুলো ছাড়া এ সাহস সহসা কেউই করে না। তবে বর্তমান সময়ে নতুন একটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। যেসব রকেট বা মিসাইল আকাশে পাঠানো হয়, সেগুলো কয়েকটি অংশে বিভক্ত থাকে। যখন সেগুলোকে ওপরে ছোড়া হয় তখন কয়েকভাগ হয়ে যায়। এরমধ্যে মাত্র একটি অংশ আকাশে যায়, যেটি রাসায়নিক পদার্থ থাকে। বাকি টুকরোগুলো নিচে নেমে আসে। যে অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যায় সেটা নামার পথে প্যারাশুটে করে নামে। যাতে নষ্ট না হয়ে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী হতে পারে।

অনেকে দেশে আবার বিমানে করে উপরের মণ্ডলে গিয়ে বৃষ্টি উৎপাদক পদার্থ ছড়িয়ে দেয়। কারণ অনেক সময়ে রকেট বা মিসাইলের মাধ্যমে পাঠালে লাভের চেয়ে অপচয় হয় বেশি। সে তুলনায় বিমানে করে উপরে গিয়ে রসায়ন ছিটিয়ে দিয়ে অধিক উপযোগ পাবার নিশ্চয়তা থাকে বেশি। বিমানে করে প্রথম যেদিন কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া করা হয় সেদিন প্রথম দফা রসায়ন ছিটিয়ে দেয়ার পর রাডারে ধরা পরে আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি হতে পারে। পরে আরেক দফা রসায়ন ছিটানোর ফলে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামে। অল্প-স্বল্প এলাকা নিয়ে নয়, বিশাল এলাকা নিয়ে নামে সে বৃষ্টি। বিমানের পাখার নিচে বিশেষ কায়দা করে রাসায়নিক পদার্থের বাহক রাখা হয়, উপরে উঠার পর সময় হলে সে বাহকের মুখ খুলে দেয়ার পর রাসায়নিক বের হতে থাকে ক্রমান্বয়ে।

বিজ্ঞানের দিন দিন অগ্রগতি হচ্ছে, সব ক্ষেত্রেই উন্নতি হচ্ছে। কম ব্যয়ে অধিক লাভবান হচ্ছে বিশ্ব। আগের চেয়ে অপেক্ষার পালাও কমছে। বৃষ্টি নামানোর প্রযুক্তিতেও তেমনটা ঘটেছে। প্রথমে এল রকেট বা মিসাইল পদ্ধতি। এরপর বিমানে করে রাসায়নিক ছিটানো। সেটাও সেকেলে ও অনেক সময় সাপেক্ষ। তাই বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন লেজার বীম ব্যবহার করে মাটিতে বসেই শক্তিশালী রশ্মি দিয়ে বৃষ্টি নামাতে।

লেজার বীম দিয়ে যদি বৃষ্টি নামানো সম্ভব হয়, তাহলে ঢাকার রাস্তায়ও ভ্যাপসা গরমের মাঝে বৃষ্টি নামিয়ে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা যেতে পারে! কারণ লেজার প্রযুক্তি হলে এটা ব্যয়বহুল হবার কথা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা মেঘের ওপর উচ্চশক্তির লেজার রশ্মি ফেলে বৃষ্টি নামানোর উপায় বের করতে গবেষণা করছেন।

‘ক্লাউড সিডিং’ এর ব্যবহার

কোনো একটি এলাকায় কৃত্রিম বৃষ্টির মাধ্যমে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১০%-২০% বাড়ানো সম্ভব। খরাপ্রবণ এলাকায় ফসল ফলাতে এ কৌশল বেশ কার্যকর। কৃত্রিম বৃষ্টিপাত প্রক্রিয়া ব্যবহার করে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভারী বৃষ্টিপাত ও হারিকেনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হয়। ঘূর্ণিঝড় এলাকায় প্রচুর মেঘ থাকে, থাকে নিম্নচাপও। যখন সে ঘূর্ণিঝড় প্রবল শক্তি নিয়ে লোকালয়ে আঘাত করে তখন ক্ষয়ক্ষতির শেষ থাকে না। এমন অবস্থায় সেখানকার ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে ক্লাউড সিডিং প্রক্রিয়া ব্যবহার করে বৃষ্টি ঝরিয়ে ঘূর্ণিঝড়কে দুর্বল করে ফেলা যায়। সম্প্রতি এই কাজটিই করছে ইন্দোনেশিয়া।

২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিক গেমসের ঠিক আগে ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে বৃষ্টি ঝরিয়েছিল চীন, যাতে পুরো আয়োজন বৃষ্টির কারণে বিঘ্নিত না হয়।  চীনই সবচেয়ে বেশি কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টি ঝরায়। এমনকি অতিমাত্রায় এ কৌশল ব্যবহারের কারণে চীনের বিরুদ্ধে বৃষ্টি চুরির অভিযোগ করে প্রতিবেশীরা। ভারতেও কৃত্রিম বৃষ্টি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে।  

চীন, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ইসরায়েল, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, বুলগেরিয়া, ফ্রান্স, স্পেন, রাশিয়া, জার্মানি, স্লোভেনিয়া, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকার মালি, নাইজার, মরক্কো, বুরকিনা ফাসো এবং সেনেগাল বেশ কয়েকটি ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে।

আগামীনিউজ\মিথুন

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে