Dr. Neem on Daraz
Victory Day

সামনের দিনগুলো ভয়ের


আগামী নিউজ | আমাদের সময় প্রকাশিত: মার্চ ৩১, ২০২০, ০৩:৫০ এএম
সামনের দিনগুলো ভয়ের

দেশের মানুষের মধ্যে করোনা কতটা সংক্রমিত হয়েছে, এ মহামারী কতটা বিস্তৃত হয়েছে; অর্থাৎ বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের প্রকৃত অবস্থা কী- সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। করোনার নানা লক্ষণ বা উপসর্গ নিয়ে প্রতিদিন যে সংখ্যক মানুষ পরীক্ষা করার জন্য রাজধানীর রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) যোগাযোগ করছেন, তাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক মানুষেরই পরীক্ষা করা হচ্ছে।

একটি পরিসংখ্যান থেকেই এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। করোনার লক্ষণ-উপসর্গের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৭২৫ জন কল করেছেন। এর মধ্যে করোনা সংক্রান্ত কল ছিল ৩ হাজার ৯৯৭টি। আর একই সময়ে মাত্র ১৫৩টি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন করোনায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত করা হয়েছে।

সার্বিক বিবেচনায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ অবশ্যই বাড়াতে হবে। এত অল্প পরিমাণ পরীক্ষা করে দেশে করোনার বিস্তৃতি কতটা, তা বোঝা অসম্ভব। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনার লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে সন্দেহভাজন কিছু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করার পর ফল পেয়ে বোঝা যাবে, করোনার সর্বশেষ পরিস্থিতি কী এবং এটি সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে কিনা। করোনার লক্ষণ-উপসর্গ থাকা রোগীর মৃত্যু এবং করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা কম হওয়ায় এ মহামারী ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন তারা। প্রত্যেকেই বলছেন, করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা অবশ্য-অবশ্যই বাড়াতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। শনাক্ত করতে যত দেরি হবে, ততই তা পুরো দেশের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি ডেকে আনবে।

আইইডিসিআরে গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের শনাক্তকরণ পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর পর থেকে গতকাল সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত মাত্র ১৩৩৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। কাজেই এ পর্যন্ত সারাদেশে মাত্র ৪৯ জনের দেহে এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ভেবে স্বস্তির অবকাশ নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা রোগী শনাক্তকরণ পরীক্ষার পরিমাণ বাড়ানো এবং সর্দিজ্বরসহ করোনায় চিকিৎসায় ডেডিকেটেড হাসপাতাল নির্মাণ করে সেবাদানের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক ভিসি ভাইরোলজিস্ট ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনার প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝা যাচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনার লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে সন্দেহভাজন কিছু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। তাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পরীক্ষার ফল পেলে বোঝা যাবে, এটি সমাজে বিস্তৃত হয়েছে কিনা। এ ছাড়া যাদের কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়েছে, তাদের মেয়াদ শেষ হবে ৫ এপ্রিল। কোয়ারেন্টিনের মেয়াদ ও কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের (সমাজ, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সংক্রমিত হওয়া) ওপর নির্ভর করছে সব কিছু। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে থাকলে সামনের দিনগুলো খুবই ভয়াবহ হতে পারে।

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা বাড়াতেই হবে। পরীক্ষা করা না হলে কার দেহে ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে সেটি জানা গেল না। এতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেশি। এখন অনেক মানুষ গ্রামে অবস্থান করছেন, সে পর্যন্ত পরীক্ষা বিস্তৃত করতে হবে। এর বিকল্প নেই।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগী কমসংখ্যক শনাক্ত হলেও এটি সংক্রমণের দিক থেকে এখন তৃতীয় স্তরে রয়েছে। কারণ মহামারীর কারণে কোনো এলাকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লকডাউন করা হলে সেটি তৃতীয় স্তর হিসেবে গণ্য হয়। আমাদের দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নে আমি বলব- অবশ্যই আছে। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে বলেই বিদেশ ফেরতদের পরিবারের সদস্যের বাইরের মানুষও আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে। এমন একটি মৃত্যুর পর ওই এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। করোনা বেশি ছড়িয়েছে কিনা সেটি জানতে হলে পরীক্ষার হার বাড়াতে হবে। অল্প কিছু টেস্ট করে এটি নিশ্চিত হয়ে বসে থাকলে বিপদ আসন্ন। করোনার সংক্রমণ যাদের মধ্যে রয়েছে, তাদের শনাক্ত করতে দেরি হলে এবং আক্রান্তদের আইসোলেশনে চিকিৎসাসেবা দেওয়া না হলে সংক্রমণ ছড়াতেই থাকবে। পরবর্তীকালে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব আছে, তাদের শনাক্তকরণের জন্য পরীক্ষার আওতায় আনা দরকার। এখন পরীক্ষার পরিমাণ বাড়াতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

তিনি আরও বলেন, করোনায় আক্রান্ত সব রোগীকে হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন হবে না। যাদের লক্ষণ-উপসর্গ মৃদু, তাদের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হয়। এ ধরনের রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮০ থেকে ৮২ শতাংশ হয়। বাকি যেই ১৮ থেকে ২০ শতাংশ রোগী আছেন, তাদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। সর্দিজ্বর, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট- এগুলো হচ্ছে করোনা ভাইরাসের লক্ষণ-উপসর্গ। আমরা শুনেছি, হাসপাতালগুলোতে সর্দিজ্বরে আক্রান্তরা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। এখন আমাদের মূল কাজ হবে দুটি। একটি হলো- করোনার রোগী শনাক্ত করতে পরীক্ষার পরিমাণ বৃদ্ধি করা; আর দ্বিতীয়টি হলো- যারা সর্দিজ্বরে আক্রান্ত তাদের চিকিৎসার জন্য ডেটিকেটেড হাসপাতালের ব্যবস্থা করে চিকিৎসা দেওয়া। ডেডিকেটেড হাসপাতালে সর্দিজ্বরের রোগীরা চিকিৎসা নিতে যাবেন এবং তাদের মধ্যে সন্দেহভাজনদের টেস্ট করা হবে। তাদের মধ্যে কেউ করোনায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত হলে তাকে আইসোলেটেড করে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি এ কাজ না করা হয়, সর্দিজ্বরে আক্রান্তদের মধ্যে করোনা আক্রান্ত কেউ থেকে থাকলে, তিনি নিজে সুস্থ হয়ে ফিরলেও তার মাধ্যমে আরও অনেকে আক্রান্ত হবেন। এতে করে করোনায় আক্রান্ত হওয়া অনেক রোগী অজ্ঞাতসারেই অন্যের সংস্পর্শে যাবেন এবং তাদের সংক্রমিত করবেন। সেসব সংক্রমিত মানুষ আবার অন্যদের সংক্রমিত করবেন। এভাবে সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে। এবং একসময় দেখা যাবে, অনেক মানুষই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো, তাদের হয়তো হাসপাতালে যেতে হবে না। কিন্তু যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম কিংবা যারা বয়স্ক বা যাদের ক্রমিক ডিজিজ আছে, তাদের হাসপাতালে নিতে হবে। তখন এত পরিমাণ রোগী হতে পারে, যার চাপ সামাল দেওয়া হয়তো অসম্ভব হয়ে যাবে। আমার পরামর্শ হচ্ছে- ডেটিকেটেড হাসপাতাল করে সর্দিজ্বরের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনার লক্ষণ-উপসর্গ থাকা রোগীদের অবশ্যই করোনা আক্রান্ত কিনা তা টেস্ট করা। অন্যথায় আমাদের সামনে হয়তো ভয়াবহ বিপদ।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক আহমেদ বলেন, করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি আগামী এক-দুই সপ্তাহে বোঝা যাবে না। এটি কয়েক মাস পর্যন্ত বিস্তার ঘটাবে। এখন ধীরে ধীরে বাড়ছে। যদি বিষয়টি আমরা সবাই মিলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তো ভালো, তা হলে ধীরে ধীরে চলতে থাকবে। আর যদি আমাদের অলক্ষ্যে কোথাও কোনো মানুষ বিষয়গুলো না মানেন, আমাদের দুর্বলতা থাকে, তা হলে কোনো কোনো এলাকায় এটির ব্যাপক সংক্রমণ ঘটতে পারে। বিভিন্ন দেশে তা-ই দেখা গেছে। এখন আমাদের সন্তুষ্টির কোনো বিষয় নেই যে, আমাদের দেশে রোগী কম আছে। হাফ ছেড়ে বাঁচার অবকাশ নেই। মানুষ যদি নির্দ্বিধায় মেলামেশা করতে থাকে, তা হলে এটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। তিনি আরও বলেন, মৃদু সংক্রমণ লক্ষণযুক্ত করোনার রোগী যদি থাকে, তা হলে তিনি হয়তো টেরই পাবেন না। হয়তো এমনি ভালো হয়ে যাবেন, হাসপাতালেও যেতে হবে না। কিন্তু তিনি যেসব মানুষের সঙ্গে মিশবেন, তারা এবং তাদের মাধ্যমে অন্য অনেকেই সংক্রমিত হবেন। এ ক্ষেত্রে হঠাৎ করে একসঙ্গে অনেক রোগী শনাক্ত হতে পারেন। তখন খুবই জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এটি কখনই মনে করা যাবে না যে, আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছি।

ডা. মুশতাক বলেন, বাংলাদেশে এ মহামারী প্রথম পর্যায়ে রয়েছে। সবাই যদি সতর্ক না হই, কোয়ারেন্টিন মেনে না চলি, শারীরিক দূরত্ব বজায় না রাখি, অযথা মিক্সিং পরিহার না করি- তা হলে সামনের দিন খুবই কঠিন হতে পারে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এমনটিই দেখা গেছে। যদি আমরা জনস্বাস্থ্যবিষয়ক ইন্টারভেশন মেনে চলি, তা হলে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব।

আগামী নিউজ/নাঈম

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে