Dr. Neem on Daraz
Victory Day

পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধিতে খুশি বিক্রেতারা, বিপাকে সাধারণ ক্রেতারা


আগামী নিউজ | নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: অক্টোবর ১২, ২০২১, ১০:৪৬ পিএম
পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধিতে খুশি বিক্রেতারা, বিপাকে সাধারণ ক্রেতারা

ফাইল ছবি

ঢাকাঃ পেঁয়াজের দাম বেড়েই চলছে। বিক্রেতারা খুশি হলেও ক্রেতা সাধারণের মনে অস্থিরতা বিরাজ করছে, অধিক লাভবান মধ্যস্বত্বভোগীরা। এখন বাজারে পেঁয়াজের যে দাম তাতে আমরা খুশি। এরকম দাম সারা বছর থাকা দরকার। পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার কুমিরগাড়ী গ্রামের পেঁয়াজচাষি মিল্লাদ হোসেন একথা বলছিলেন। একই গ্রামের ইয়াকুব আলীসহ অনেক চাষিই এমনটি বলেছেন। বাজারে পেঁয়াজের ভালো দাম পেয়ে অনেক কৃষকের মুখে হাসি। তবে বেশিরভাগ চাষি আগেই অধিকাংশ পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন।

অন্যদিকে যেসব বিত্তবান পেঁয়াজ কিনে মজুত করে রেখেছিলেন সেসব মধ্যস্বত্বভোগীদের এখন পোয়াবারো। সাধারণ চাষিদের লাভবান করতে হলে মৌসুমেও ভালো দাম নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা তা অনেকাংশে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে চলে যায় বলে দাবি করেছেন চাষি সংগঠকরা। কৃষি বিভাগ বলছে পেঁয়াজের এ দামে চাষিরা কিছুটা লাভবান হচ্ছেন। উৎপাদন খরচের তুলনায় দাম অসহনীয় হয়নি।

তাছাড়া চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পেঁয়াজ জেলায় মজুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছর জেলার ৯ উপজেলায় পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৭ লাখ ২০ হাজার ৯৮৫ মেট্রিক টন। উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় ২০ শতাংশ পেঁয়াজ এখনও জেলায় মজুত বলে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে। হালি বা কন্দ পেঁয়াজ উঠতে এখনও আড়াই মাস সময় লাগবে। সে পর্যন্ত মজুত পেঁয়াজ দিয়ে অনায়াসে চাহিদা মিটে যাবে।

এদিকে পাবনার বিখ্যাত পেঁয়াজ হাট বনগ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সপ্তাহ আগে যে পেঁয়াজের দাম ছিল ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা প্রতি মণ, এখন তার (বড় পেঁয়াজ) দাম দুই হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা। তবে বীজ পেঁয়াজের দাম প্রতি বছরই একটু বেশি থাকে। এখন বীজ পেঁয়াজ (ছোট পেঁয়াজ) প্রতি মণ ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে জানা গেছে, পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কিছুদিন হলো পেঁয়াজ আসা বন্ধ। দুর্গাপূজার পর আবার পেঁয়াজ আসা শুরু হলে বাজার কমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্রমিকের উচ্চ দাম আর কৃষি উপকরণের দাম বেড়েছে অনেক। কিন্তু বছরের পর বছর কৃষিপণ্যের দাম বাড়েনি। কৃষকের উৎপাদন খরচ ওঠে না, উঠলেই সামান্য লাভ থাকে, যা দিয়ে সংসার চালানো যায় না।পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার চাষি আব্দুল বাতেন (৪০) বলেন, যে টাকা খরচ করি আর যদি সেই টাকাই পাই তাহলে লাভ কী? জমি চাষ করে পরিশ্রম দিয়ে লাভ কী হবে?

তিনি জানান, বিগত বছরগুলোতে এমনটিই হয়ে আসছিল। ক্ষতি হতে হতে অনেক চাষি জমিতে আবাদ ছেড়ে জমি লিজ দিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু এবছর চাষিরা বছরের শেষ দিকে পেঁয়াজ বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন।

ওই চাষি বলেন, এমন দাম সারা বছর থাকলে আমরা খুশি হবো। কুমিরগাড়ী গ্রামের পেঁয়াজ চাষি মিল্লাদ হোসেন (৪৪) তার ঘরে রাখা পেঁয়াজ দেখিয়ে জানান, পুরো ঘরে পেঁয়াজের পচা গন্ধ। পেঁয়াজের পচন ঠেকাতে ঘরে একাধিক ফ্যান চলছে সবসময়, এরপরও পচন ঠেকানো যাচ্ছে না। মৌসুমে ২০-২৫ বিঘা জমিতে যে পেঁয়াজ পেয়েছিলাম তা বেশিরভাগ বিক্রি করেছি। ভালো দাম পাইনি। এখন বছরের শেষ দিকে এসে কিছু পেঁয়াজের ভালো দাম পাচ্ছি। আমরা আগে যে কম দামে বিক্রি করেছি সেটা কেউ বুঝতে চান না।

আতাইকুলা থানার চরপাড়া গ্রামের চাষি নায়েব আলী (৪৫) জানান, তিনি প্রতি বছরই পেঁয়াজ চাষ করেন। প্রতি বছরই পেঁয়াজের ক্ষেত বৃষ্টি বা শিলা বৃষ্টির কবলে পড়ে। তাই পচন ধরায় অনেক সময় পেঁয়াজ ঘরে রাখা যায় না। মৌসুমেই অনেক পেঁয়াজ বিক্রি করে দিতে হয়।

তিনি বলেন, বৈশাখ এলেই দোকানে দোকানে হালখাতা শুরু হয়। তখন পেঁয়াজ বিক্রি করে তারা দেনা শোধ করেন। যে পেঁয়াজ ঘরে থাকে তা ধীরে ধীরে শুকিয়ে ওজন হারায়। তাছাড়া অনেক পেঁয়াজে পচন ধরে। মাঝে মধ্যেই মাচা থেকে পেঁয়াজ নামিয়ে বাছাই করে আবার মাচায় রাখতে হয়। এতে দেখা যায় মৌসুমের চেয়ে বছরের শেষ দিকে পেঁয়াজের ওজন কমে অর্ধেক হয়ে যায়। দাম বাড়লে যতটা লাভ মনে হয় আসলে সে পরিমাণ লাভ হয় না।

চাষিদের সঙ্গে একমত পোষণ করে পাবনার দোতলা কৃষির উদ্ভাবক কৃষিবিদ জাফর সাদেক বলেন, বোরোতে লোকসান, আউশে খরা, আমনে হতাশা; এই হলো চাষির দশা। এ অবস্থায় পেঁয়াজই এখন পাবনার চাষিদের জীবন রক্ষাকারী ফসল বলা যায়। পাবনার অনেক কৃষক পেঁয়াজ চাষের সাথে সম্পৃক্ত। পেঁয়াজের সাথে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক বিষয়টিও সম্পৃক্ত।

জাফর সাদেক বলেন, পেঁয়াজের সঙ্গে মধ্যস্বত্বভোগীর একটা ব্যাপারও জড়িয়ে গেছে। পেঁয়াজ চাষিরা সংসারের তাগিদে মৌসুমেই বেশিরভাগ পেঁয়াজ বিক্রি করেন। সে সময়ে কম দামে অনেকে পেঁয়াজ কিনে বাঁধাই করে। আবার অনেক লোক ব্যাংকে কম মুনাফা বলে টাকা খাটান বাঁধাই ব্যবসায়। বছরে শেষদিকে দাম বাড়লে তারা সে পেঁয়াজ বিক্রি করেন। এতে বড় চাষি ও মজুতকারীরা লাভবান হন। ছোট চাষিরা আগেই পেঁয়াজ বিক্রি করেন। বহু এলাকায় শ্রম দেয় কৃষক আর লাভ যায় মজুতদারদের পকেটেআবহাওয়া বিপর্যয়ের কারণেও পেঁয়াজ চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, পেঁয়াজ চাষ করতে গিয়ে কৃষককে এখন রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। অনাবৃষ্টি ও অসময়ের বৃষ্টি বা শিলাবৃষ্টিতে প্রায় বছরই চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।তিনি আরও বলেন, পেঁয়াজের দাম সারা বছর বেশি থাকা দরকার। পেঁয়াজের ভালো দাম হওয়াটা ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত। অন্য দশটি পেশার লোকজনের আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু চাষিরা ফসলের ভালো দাম পেলেই দাম কমানোর দাবি ওঠে। কিন্তু চাষিরা ভালো দাম না পেলে তারা টিকে থাকবে কীভাবে?

পাবনার ঈশ্বরদীর চাষি ও বাংলাদেশ ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) কেন্দ্রীয় সভাপতি আলহাজ শাহজাহান আলী বাদশা জানান, চাষি বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। সেই চাষিরা বছরের পর বছর ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না। তিনি দুঃখ করে বলেন, এমন একটা মানসিকতা এসেছে- সবকিছুর দাম বাড়বে, সবার আয় রোজগার বাড়বে কিন্তু চাষির পণ্যের দাম বাড়তে পারবে না। চাষি সারাজীবন একই দামে উৎপাদিত পণ্য বেচে যাবেন! এটা থেকে বেরিয়ে আসার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। দিন বদলেছে, তাই কৃষিপণ্যের দামও বাড়বে এটা সবারই মেনে নিতে হবে। তাহলে এদেশের চাষি বাঁচবে, কৃষি বাঁচবে।

কৃষি বিপণন অধিপ্তরের পাবনা জেলা মার্কেটিং অফিসার হুমায়ুন কবীর জানান, চাষি ভালো দাম পেলেই সেটাকে নেতিবাচকভাবে না দিয়ে ইতিবাচক দিকটিও ভাবতে হবে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে চাষিদেরও তো লাভবান হতে হবে। চাষির উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সেটিও চিন্তা করতে হবে।তিনি বলেন, আমদানি করা পেঁয়াজের দাম পড়ছে কেজিপ্রতি ৪০-৪৩ টাকা। বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪৬- ৪৭ টাকা। আমাদের দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ উৎকৃষ্টমানের। সেদিক থেকেও দেশের পেঁয়াজের দাম একটু বেশি হওয়া স্বাভাবিক। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষের আয় বেড়েছে। সবার ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। পাবনায় এখনও মোট উৎপাদনের অন্তত ২০ শতাংশ পেঁয়াজের মজুত রয়েছে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, পাবনার উপ-পরিচালক আব্দুল কাদের জানান, চাষিরা বছরের শেষ দিকে এসে পেঁয়াজের ভালো দাম পাচ্ছেন। এর সাথে কিছু বাঁধাইকারীও রয়েছেন। বাজারদর অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে এমনটিও নয়। কেজিপ্রতি ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেলে তখন পেঁয়াজ আমদানি করার কথা ভাবা যেতে পারে। চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন, এটা কৃষিকাজের জন্য আশার কথা। বছরের পর বছর ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকলে চাষিরা তো কৃষি পেশাটাই ছেড়ে দেবেন।

আগামীনিউজ/শরিফ 

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে