চট্টগ্রামঃ ঝর্ণা দেখতে গিয়ে মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় নিহত ১১ জনের লাশ আইনি প্রক্রিয়া শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
শুক্রবার (২৯ জুলাই) রাতে একে একে মরদেহগুলো পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করে রেলওয়ে পুলিশ।
রেলওয়ের পুলিশ সুপার হাছান চৌধুরী লাশ হস্তান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে শুক্রবার এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় উপলক্ষে ছুটির দিনে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝর্ণায় গিয়েছিলেন নিহতরা। সেখানে গিয়ে ঝর্ণার পানিতে হৈ-হুল্লোড় করেন। নানা ভঙ্গিতে ছবিও তোলেন। যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ারও করেছিলেন। তবে দুপুরের দিকে ফেরার পথে উপজেলার বড় টাকিয়া রেলস্টেশন এলাকার ট্রেনলাইন অতিক্রমকালে মহানগর প্রভাতী ট্রেন তাদের মাইক্রোবাসটিকে ধাক্কা দিলে সবার সেই আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়।
ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন- উপজেলার আজিম সাবরেজিস্ট্রার বাড়ির হাজি মো. ইউসুফের ছেলে মাইক্রোচালক গোলাম মোস্তফা নিরু (২৬), চিকনদণ্ডী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মো. ইলিয়াছ ভুট্টোর ছেলে মোহাম্মদ হাসান (১৭), একই ইউনিয়নের খোন্দকার পাড়ার আবদুল হামিদের ছেলে জিয়াউল হক সজীব (২২), ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আজিজ মেম্বার বাড়ির জানে আলমের ছেলে ওয়াহিদুল আলম জিসান (২৩), মজিদ আব্বাস চৌধুরী বাড়ির বাদশা চৌধুরীর ছেলে শিক্ষক রিদুয়ান চৌধুরী (২২), পারভেজের ছেলে সাগর (১৭) ও একই এলাকার আবদুল ওয়াদুদ মাস্টার বাড়ির আবদুল মাবুদের ছেলে ইকবাল হোসেন মারুফ (১৭), ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মোজাফফর আহমেদের ছেলে মোসহাব আহমেদ হিসাম (১৬), আব্দুল আজিজ বাড়ির মৃত পারভেজের ছেলে তাসমির হাসান (১৭), মনসুর আলমের ছেলে মো. মাহিম (১৭), ২ নম্বর ওয়ার্ডের আবু মুসা খানের বাড়ির মোতাহের হোসেনের ছেলে মোস্তফা মাসুদ রাকিব (১৯)।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কোচিং সেন্টারের শিক্ষক-শিক্ষার্থী খৈয়াছড়া ঝর্ণাসহ মিরসরাইয়ের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র দেখতে ৫০০ টাকা করে চাঁদা তোলেন। পরে শুক্রবার সকালে মাইক্রোবাস নিয়ে রওয়ানা দিয়ে খৈয়াছড়া ঝর্ণায় যান। এরপর সেখান থেকে ফেরার পথে দুপুর পৌনে একটার দিকে মিরসরাইয়ের বার তাকিয়া স্টেশনে ঢোকার মুখে রেলক্রসিংয়ে ঘটে এ দুর্ঘটনা। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মহানগর প্রভাতী ট্রেন তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটিকে টেনে প্রায় এক কিলোমিটার পর্যন্ত নিয়ে যায়।
যদিও পূর্ব রেলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আনসার আলী দাবি করেছেন, ট্রেন আসায় গেইটম্যান সাদ্দাম হোসেন বাঁশ ফেলে রাস্তা আটকে দিয়েছিলেন। কিন্তু মাইক্রোবাসটি বাঁশ ঠেলে ক্রসিংয়ে উঠে পড়ে। এতে মাইক্রোবাসটি ট্রেনের ইঞ্জিনের সঙ্গে আটকে যায় এবং একই অবস্থায় মাইক্রোবাসটিকে প্রায় এক কিলোমিটার পথ ছেঁচড়ে নিয়ে যায় ট্রেনটি।
তবে ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া মাইক্রোবাসের যাত্রী ইমন জানিয়েছেন, ‘মাইক্রোবাসে আমরা সবাই গল্প-আড্ডায় ফিরছিলাম। ক্রসিংয়ে কোনো ব্যারিকেড ছিল না। সেখানে গেটম্যানও ছিলেন না। মাইক্রোবাস যখন একেবারে লাইনের ওপর উঠে যায়, ঠিক তখন খুব জোরে ট্রেনের হুইসেল শুনতে পাই। মুহূর্তেই ট্রেন আমাদের মাইক্রোবাসে ধাক্কা দেয়। এরপর অনেক দূর পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে যায়।’
ইমন আরও বলেন, ‘যেদিক দিয়ে ট্রেন মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিয়েছে, তার উল্টো দিকে জানালার পাশে ছিলাম আমি। ট্রেনের গতি যখন কমে যায়, অনেকটাই থেমে গেলে জানালা দিয়ে আমি বেরিয়ে আসি। এরপর আশপাশের লোকজন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।’
দুর্ঘটনায় নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বেঁচে ফিরলেও আহত হয়েছেন ইমন। তবে শারীরিকভাবে ভালো থাকলেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি। বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ২৪ নম্বর সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসা চলছে তার।
এদিকে, দুর্ঘটনা নিয়ে পাল্লাপাল্টি বক্তব্যের পর ইতোমধ্যেই গেটম্যান সাদ্দামকে আটক করেছে রেলওয়ে পুলিশ। বর্তমানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে তদন্তে তার গাফিলতি পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে, ১১ জন নিহতের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। পূর্ব রেলের ডিটিও আনসার আলীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের এই কমিটি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে কমিটিকে দ্রুততম সময়ে কারণ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এসএস